সুপ্রভাত ডেস্ক »
করদাতা সুরক্ষা পরিষদের ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা, তার পাল্টায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের অবস্থান, স্মারকলিপি দিতে গিয়ে নগর ভবনে আলোচনা এবং একই সময়ে হামলা। সব ঘটল একইদিনে।তারপর আগের অবস্থানেই অনড় চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ এবং সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।
বর্ধিত গৃহকর বাতিলের দাবিতে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে এই আন্দোলন। তার মধ্যেই বুধবার ঘটল এতসব ঘটনা। হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। তারা জানিয়েছে, আন্দোলন চলবে।আর মেয়র রেজাউল বলছেন, আপিল বোর্ডের কার্যক্রমে গৃহকর নিয়ে ‘খুশি’ নগরবাসী। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করছে।
স্থাপনার আয়তনের পরিবর্তে ভাড়ার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা গৃহকর বাতিলের দাবিতে সোমবার নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল করদাতা সুরক্ষা পরিষদ।
পরদিন মঙ্গলবার সমাবেশ করে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় মেয়রের অনুসারী ‘চট্টগ্রাম সচেতন নাগরিক সমাজ’।
বুধবার বেলা ১১টার দিকে কদমতলী মোড় থেকে যখন সুরক্ষা পরিষদ নগর ভবন অভিমুখে মিছিল নিয়ে রওনা হয়, তখনও মিছিলের সামনে ব্যাপক পুলিশ প্রহরা ছিল।
এর আগে সকাল ৯টার পর থেকে টাইগার পাসের বাটালি রোডে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) অস্থায়ী নগর ভবনের মূল ফটকে তালা দেওয়া হয়।
বেলা ১১টার দিকে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নেয় নগরীর এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের একাংশ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) শ্রমিক কর্মচারী লীগের নেতা-কর্মীরা।
বেলা ১২টার দিকে তারা নগর ভবনের কাছে টাইগার পাস মোড়ে সবুজ বিপ্লব নার্সারির সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান ও বক্তব্য দিতে থাকে।
পৌনে ১টার দিকে পুলিশ প্রহরায় করদাতা সুরক্ষা পরিষদের চারজন প্রতিনিধি নগর ভবনে স্মারকলিপি দিতে আসেন।
ওই দলে ছিলেন- করদাতা সুরক্ষা পরিষদের জ্যেষ্ঠ সভাপতি আব্দুল মালেক, সহ সভাপতি ইসমাইল মনু, সহসাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদাউস পপি ও মুখপাত্র কাজী শহীদুল হক স্বপন।
বাড়ি ভাড়ার ভিত্তিতে নির্ধারিত বর্তমান গৃহকর পুনঃমূল্যায়ন বাতিল, আগের মতো আয়তনের ভিত্তিতে নতুনভাবে গৃহকর মূল্যায়ন করা, আপিলের নামে ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নাগরিক সেবা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি রোধে প্রতিবছর গণশুনানি আয়োজন এই চার দাবি স্মারকলিপিতে জানায় করদাতা সুরক্ষা পরিষদ।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের কাছে তারা স্মারকলিপি দেন।
এসময় করদাতা সুরক্ষা পরিষদের মুখপাত্র কাজী শহীদুল হক বলেন, আমরা দাবি জানাতে এসেছি। কর্মসূচি ঘোষণার সময়ই বলেছি আমরা নগর ভবনে এসে স্মারকলিপি দিব। আমরা সবাই বয়স্ক মানুষ, কোনো সংঘাত করতে আসিনি। কিন্তু পুলিশ আমাদের বাধা দিল।
এসময় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আপনারা আগে কখনও মেয়র মহোদয়ের সাথে দেখা করতে আসেননি। উনার দরজা সবার জন্য খোলা। চিঠি দিতে বা ডাকতে হয় না। এরকম দেখা করতে আসলেই পারতেন। খবর বিডিনিউজ।
আপনারা সরাসরি ঘেরাও করতে এসেছেন। আপনাদের সাথে আমাদের দেখা করা বা কথা বলারই কথা না। তবু বলছি। আমরাও তো আপনাদের সন্তান। ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে আমরা শঙ্কিত। শহরের আয়তন প্রতিদিন বাড়ছে। রাজস্বের টাকাতেই আমাদের বেতন হয়, সিটি করপোরেশন চলে, আপনাদের সেবা দিই। আমাদের ৯২টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫৬ টা স্বাস্থ্য কেন্দ্র চলে। অন্য সিটি করপোরেশনে ২৬% পর্যন্ত গৃহকর বেড়েছে।
পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদাউস পপি বলেন, পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা আন্দোলন করছি। আগের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন চিঠি দিয়ে আমাদের আলোচনায় ডেকেছিলেন। বর্তমান মেয়র কখনও ডাকেননি। আজকে আমরা আসব সেটা মেয়র জানতেন। উনি এখন কেন নেই, সেটা আমরা জানি না।
সিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আপনারা যেসব দাবি নিয়ে এসেছেন তারমধ্যে প্রথম দুটি মেয়রের এখতিয়ারে নেই। তৃতীয় ঘুষ বাণিজ্যের কথা বলেছেন। আমি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই মেয়র মহোদয় আমাকে বলে দিয়েছেন, এ বিষয়ে দেখতে। সেটা দেখছি। আর নাগরিক সেবায় গণশুনানি চেয়েছেন, সেটা আমরা দেখব। আপনাদের দাবির বিষয়ে আমি মেয়র মহোদয়কে জানাব।
মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাশেম বলেন, আপনারা গৃহকর আপিলে ঘুষ বাণিজ্যের কথা ঢালাও ভাবে বলছেন। ব্যবস্থা না নিলে আমাদের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের চাকরি গেল কীভাবে? আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিষদের সহ সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদাউস বলেন, নগর পিতা হিসেবে উনি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে পারেন যাতে নতুন করে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা কয়েকদিন অপেক্ষা করব। উনি ঘোষণা দিক, উনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন বা করবেন। তারপর পরবর্তী কর্মসূচি জানাব।
পরিষদের প্রতিনিধিরা যখন নগর ভবনে আলোচনায় ছিলেন তখনই টাইগার পাস মোড়ে পরিষদের নেতা-কর্মীদের উপর মিছিল নিয়ে হামলা চালায় নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা।
মেয়র নগর ভবনে ‘নেই’ জানালেও করদাতা সুরক্ষা পরিষদের প্রতিনিধি দল চলে যাওয়ার পর কর্মকর্তারা জানান, মেয়র এক সভায় ছিলেন।
এর কিছুক্ষণ পর নিজ কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হন মেয়র রেজাউল। তাকে প্রশ্ন করা হয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে কেন তিনি গত মেয়রের মেয়াদে করা পুনঃমূল্যায়নের উপর থাকা স্থগিতাদেশ তুলে নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন?
জবাবে রেজাউল বলেন, আমি চিঠি পাঠাতে বাধ্য। কোনো নগরী ট্যাক্স ছাড়া চলে না। সহনীয় কি না, সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুরে হোল্ডিংট্যাক্স ২৭ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ২০ শতাংশ। আর এখানে ২৫টা ওয়ার্ডে ১৭ শতাংশ বাকি ১৬টিতে ১৪ শতাংশ।
আয়তনের ভিত্তিতে ট্যাক্সের বিধান সরকার করেছে সব সিটি করপোরেশনের জন্য। শুধু চট্টগ্রাম সিটির জন্য নয়। আমরা আপিল বোর্ড করেছি যাতে সহনীয় ট্যাক্স ধার্য করা যায়। সেভাবেই করছি। মানুষ সন্তুষ্ট চিত্তে ঘরে ফিরছে।
পরিষদের দাবির বিষয়ে মেয়র রেজাউল বলেন, চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, করদাতা কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। কিছু লোক, স্বার্থান্বেষী মহল উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে অযৌক্তিক দাবি তলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছি।
একটি মাত্র এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে ডিস্টার্ব করছে। অন্য কোনো ওয়ার্ডের লোক আজ এসেছে?
নির্বাচনী ইশতেহারে গৃহকর না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র রেজাউল বলেন, কেউ একতলা বাড়ি তিনতলা করলে বা নতুন বাড়ি করলে সেটার ট্যাক্স নেব না, তা তো বলিনি।
নগর ভবন ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের অবস্থান ও স্লোগান বিষয়ে প্রশ্ন করলে মেয়র রেজাউল বলেন, আমি দলের মনোনয়নে মেয়র। আমি কাউকে আসতে বা স্লোগান দিতে বলিনি। তবে আমি একটা দলের নেতা। স্বাভাবিকভাবে আমাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে অন্যরা যদি জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়, তাতে কিছু করার নেই।
‘আন্দোলন চলবে’
রাতে পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদাউস পপি বলেন, আমাদের আন্দোলন চলবে। আমাদের ওপর হামলা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।