চট্টগ্রাম বন্দরের মুনাফায় বিদেশিদের চোখ

হাবিবুল হক বিপ্লব »

বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম বন্দর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। একসময় বন্দর ব্যবহারকারীরা আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের অভিযোগ করলেও এখন সেটি নেই। প্রতি বছর বন্দরের আয়ও বাড়ছে। নিজস্ব তহবিল থেকে নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ। দুই পক্ষের প্রচেষ্টায় সারা বিশ্বের মধ্যে বন্দরের অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বন্দরের কার্যক্রম বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটি পক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একেবারে তৈরি একটি বন্দরকে বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাবে। যেখানে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দায় বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ এই সেবা খাতকে বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া আত্মঘাতী হবে।
সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য মতে, ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় হয়েছে মোট ৫ হাজার ৫৫ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রাজস্ব বেড়েছে ৮৯০ দশমিক ৮১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আয় ছিল ৪ হাজার ১৬৫ দশমিক ১৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে বিদায়ী বছরে রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এছাড়া রেকর্ড পরিমাণ কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে বন্দর। ২০১০-১১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা উন্নীত হয় ২ হাজার ৩০ কোটি টাকায়। সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই আয় উন্নীত হয়েছে প্রায় ৩ হজার ৬০০ কোটি টাকা। সরকারের আয়ের অন্যতম এই খাতের উত্থানে একটি বিশেষ মহলের নজর পড়েছে। যেখানে নিজস্ব আয় থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যাবশকীয় এই সেবার মান বাড়াতে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার কার্যক্রম ছেড়ে দেওয়া দেশের জন্য বড় ক্ষতি বলে মনে করেন অনেকে।
একসময় বন্দরের কার্যক্রমে নানা ধরনের জটিলতা ছিল। নানা ধরনের সার্ভিস চার্জ এবং উপরি মিলিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে একটি কনটেইনারের পেছনে ২ হাজার ৭০০ টাকা খরচ করতে হতো। এমনকি কনটেইনারের লোকেশন খুঁজে দেওয়ার জন্য আমদানিকারকদের প্রতি কনটেইনারে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো। নানা চার্জের কারণে উদ্যোক্তাদের আমদানি এবং রপ্তানি খরচ বেড়ে যেত বহুগুণে। এর ফলে ২০০৭ সালের পূর্ববর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বিশ্বের মধ্যে ব্যয়বহুল এবং অদক্ষ বন্দর। ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট শ্রমিক সংগঠন এবং অদক্ষতায় কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল বন্দরটি। শ্রমিক সংগঠন এবং অদক্ষ অপারেটররা সময়ে অসময়ে ধর্মঘট ডেকে বসত। এর ফলে স্থানীয় বাজারে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেত। শিল্প মালিকরা সময়মতো কাঁচামাল খালাস করতে পারত না। এখন আর সে অবস্থা নেই। বর্তমানে একটি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে সব মিলিয়ে খরচ হয় মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা।
২০০৭ সালের পূর্ববর্তী সময়ে বন্দরে একটি জাহাজের গড় অবস্থান ছিল সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ দিন। বিদেশি জাহাজ মালিকদের অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হতো। অনেক কোম্পানি তাদের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে চাইত না। কিন্তু বেসরকারি খাতের অন্তর্ভুক্তিতে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালে এখন একটি জাহাজের গড় অবস্থান সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা। একদিকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং খরচ কমে যাওয়া, অপরদিকে জাহাজের গড় অবস্থান কমে আসায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ অনেক কমে এসেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেবার মান বাড়ায় এই বন্দর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা সহজ হয়েছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের আয়ও বেড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেকর্ড ৩২ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৭ একক কনটেইনার (৩ দশমিক ২৭ মিলিয়ন টিইইউএস)এবং ১২ কোটি ৩৯ লাখ টন (১২৩ মিলিয়ন টন) কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে। ২০২৩ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৩ টিইইউএস (প্রতিটি ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের) এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ২ লাখ টন। সে হিসাবে আগের বছরের তুলনায় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৩ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে,২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৯ লাখ ৫৮ হাজার ২০ টিইইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে।২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৭ টিইইউজে। আর ২০২১ সালে মোট হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৪ টিইইউজে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল বেসরকারি খাতে পরিচালিত হওয়ায় অনেক কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় হয়েছে। এখন মোবাইলের এসএমএসের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে কনটেইনারের অবস্থান শনাক্ত করা যায়। এর ফলে সময় ও অর্থের অপচয় কমেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালের পরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে বন্দরের নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়। এতে দুর্নীতি বন্ধ করে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে বিলুপ্ত করে স্টিভিটর প্রথা বন্ধের মাধ্যমে কনটেইনার এবং জাহাজ জট মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সেবাখাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মূলত: এই সময়ে বন্দরের উৎপাদনশীলতা বাড়তে থাকে। আগে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২টি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হলেও দক্ষ অপারেটর যুক্ত হওয়ার ফলে এখন ২৫ থেকে ৩০টি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের ধারাবাহিক উৎপাদনশীলতায় ২০০৯ সালে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং জার্নাল লয়েডস-এর জরিপে বিশ্বের ১০০টি কনটেইনার বন্দরের তালিকায় ৯৮তম স্থান অর্জন করে। ২০২২ সালে এসে তা ৬৪তম স্থানে উন্নীত হয়। বিশ্লেষকদের মতে, বন্দর নিয়ে বর্তমানে ব্যবসায়ীদের কোনো অভিযোগ নেই। বন্দরের আয় বেড়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বন্দর নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। উপরন্তু বন্দরের আয় দিয়ে সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও অর্থের যোগান যাচ্ছে। তাছাড়া যেখানে এই সেবাখাতে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করেছে সেখানে বন্দর পরিচালনায় বিদেশিদের নিয়ে আসা উদ্দেশ্যপূর্ণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন যে মানে পৌঁছেছে তাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীর প্রয়োজন নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় এটিকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে বন্দরের সে সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে।