পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহী জাপানের মারুবেনি করপোরেশন
সুপ্রভাত ডেস্ক »
চট্টগ্রাম টু কক্সবাজার ধুঁকতে থাকা সড়কের উন্নয়নে একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে অনেকটা এগিয়েছে সরকার। আছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে করার পরিকল্পনাও।
প্রাথমিক সমীক্ষা শেষে দুটি প্রস্তাব উঠে এসেছে। নতুন রুটে নয়, বন্দরনগরী টু পর্যটন নগরীর বিদ্যমান দেড়শ কিলোমিটার মহাসড়ককে ঘিরেই প্রাথমিকভাবে ৪২ হাজার কোটি টাকার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
এক প্রস্তাবে বিদ্যমান সড়কের দুই পাশে কম গতির যানবাহন চলাচলের দুটি লেইনসহ ছয় লেইনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
আর দ্বিতীয়টিতে সড়কের মাঝখানে দ্বিতল সড়ক তৈরি করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
শুধু যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ এগিয়েছে তা নয়, জাপানের খ্যাতনামা মারুবেনি করপোরেশনও এগিয়ে এসেছে এ এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। অর্থায়নের পাশাপাশি জাপানি কোম্পানিটি বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পটিতে নির্মাণ কাজের দায়িত্বও পাচ্ছে; যেটি হবে সরকারি পর্যায়ে জাপান-বাংলাদেশ যৌথ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপি প্রকল্প বলে জানিয়েছেন বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল মালেক।
দেশের আরও বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিকল্পনার মধ্যেই নতুন এ এক্সপ্রেসওয়ের উদ্যোগের আলোচনাও গতি পেয়েছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মালেক বলেন, এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা নিয়ে আমরা মারুবেনি করপোরেশনের সঙ্গে গত ৩ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করেছি। আরও বৈঠক আছে। এরপর দুপক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে দ্রুততম সময়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন এবং পর্যটননগরীটির সঙ্গে বিশ্বমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে এক্সপ্রেসওয়ে রূপান্তরের এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার।
সরকার টু সরকার (জি টু জি) পর্যায়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়ন করবে জাপান। বন্ধুপ্রতীম দেশটির সঙ্গে ২০১৮ সালে প্রকল্পটি নিয়ে সমঝোতা চুক্তিও হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
প্রস্তাবিত এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের জন্য শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি মারুবেনি করপোরেশনকে বাছাইও করেছে জাপান। কোম্পানিটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি, নৌবাণিজ্য, ইস্পাত, আবাসন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং পিপিপি প্রকল্পে অর্থায়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ আরও অনেক ধরনের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
২০২৯ সালের মধ্যে এ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে বিদ্যমান ১৫১ কিলোমিটার সড়কের বাঁক সরলীকরণের মাধ্যমে ১৩১ কিলোমিটারে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এবং এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ হলে মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ভ্রমণ করা সম্ভব হবে। এতে পর্যটনে যেমন বিনিয়োগ বাড়বে, তেমনি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত হবে কক্সবাজার।
প্রকল্পটি নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগ একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। এ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশতিয়াক আহমেদের নেতৃত্বে করা এ সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন গত ডিসেম্বরে জমা দেওয়া হয়; যাতে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুনে শেষ করার চুক্তি থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সমীক্ষা দলের কাজ শেষ করতে ছয় মাস দেরি হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মারুবেনি করপোরেশনের কাছে বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রকল্পটি চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরুর জন্য এখন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কাজ করছে। এরপর সরকারের অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষের (পিপিপিএ) মহাপরিচালক (উন্নয়ন) মো. আবুল বাশার জানান, “কোনও প্রকল্প পিপিপির অধীনে বাস্তবায়ন করতে হলে সেটি পিপিপিএ এর আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তেমনিভাবে প্রস্তাবিত প্রকল্পটিও আমাদের অর্থায়নে বুয়েট থেকে সমীক্ষা শেষ হয়েছে। সমীক্ষাটি ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে জমা দেওয়া হয়েছে।
“প্রকল্পটি সরকার টু সরকারভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে। ইতিমধ্যে জাপানের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছে।”
সমীক্ষা দলের প্রধান অধ্যাপক ইশতিয়াক জানান, “জীব বৈচিত্র্য ও সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে এ প্রকল্পের জন্য দুটি বিকল্প নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করেছি।
“একটি হচ্ছে বর্তমান যে রাস্তাটি সেটাকে বড় করে এমনভাবে উন্নয়ন করা যাতে মাটির ওপর সমান্তরাল হয়। দুই পাশে দুটি কম গতির যানবাহন চলাচলের লেইনসহ ছয় লেইনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। আরেকটি হচ্ছে বিদ্যমান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর এলিভেটেড (দ্বিতল) এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা।“
তিনি বলেন, সমীক্ষায় আমরা দেখিয়েছি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম পুরো অঞ্চলটাই নানা রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে গঠিত। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সংবেদনশীল এলাকা। ওই এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের যাতে বড় ধরনের কোনও ক্ষতি না হয় সেভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দিয়েছি।
“যেনতেনভাবে শুধু উন্নত যোগাযোগের কথা চিন্তা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ওই অঞ্চলের জীব বৈচিত্র নষ্ট হবে। আবার একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে গেলে ওই মহাসড়কটির দুই পাশে আরও অনেক জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তাই অনেক মানুষের জীবন জীবিকার ওপরও প্রভাব পড়বে।“
অধ্যাপক ইশতিয়াক বলেন, “আমাদের হিসাব অনুযায়ী এলিভেটেড করতে হলে প্রকল্পটিতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। আর মাটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে এক্সপ্রেসওয়ে করতে হলে ৩০ শতাংশ ব্যয় কমবে। অর্থাৎ নীচে এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক তৈরি করলেও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।“
তিনি আরও বলেন, মহাসড়কটিতে দুটি সার্ভিসলেইনসহ ছয় লেইনের মহাসড়কে উন্নীত করতে হলে ওই রাস্তার দৈর্ঘ্য অনুযায়ী ৬৩ মিটার করে জমি দরকার হবে। বর্তমানে গড় দৈর্ঘ্য রয়েছে ৩০ মিটারের মতো। বাকি আরও ৩৩ মিটারের মতো জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, যা ওই এলাকার মানুষের জমি সম্পদ, কৃষি এবং আয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি বলেন, নিচে এক্সপ্রেসওয়ে করলে বর্ষা ও বন্যার পানি ব্যবস্থাপনা মাথায় রেখে সমতল থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিটার উচু করতে হয়। তাই বিপুল পরিমাণ মাটির দরকার হবে। এই বিপুল সংগ্রহ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পাহাড় কাটতে হতে পারে, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।
অধ্যাপক ইশতিয়াক বলেন, এসব অসুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা দ্বিতীয় একটি বিকল্প দিয়েছি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের।
এসময় তিনি এলিভেটেড অর্থাৎ দ্বিতল সড়কের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ে করাই উত্তম উল্লেখ করে বলেন, “এক্সপ্রেসওয়ে পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই টোল নিতে হবে। কিন্তু নিচে এক্সপ্রেসওয়ে করা হলে যে কোনও সংযোগ থেকে যানবাহন বা যে কেউ ওই সড়কে ঢুকে পড়তে পারে বা বিশেষ কোনও পরিস্থিতিতে ওই সড়কে মানুষজন ব্যারিকেড বা বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
“কিন্তু এলিভেটেড বা দ্বিতল সড়ক নির্মাণ করে এক্সপ্রেসওয়ে করা হলে সেখানে সাধারণ বা যে কেউ সড়কে উঠে বাধা দিতে পারবে না।“
১০০ বছরের মেয়াদ নিশ্চিত করে ৪২ হাজার কোটি টাকা বা এর কিছু কম বেশি ব্যয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
“২০২৫ সালের দিকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি শুরু হতে পারে। তখন বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়ে বন্দরের ওই ভারী যানবাহন চলাচল ওই সড়ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে,” যোগ করেন তিনি।
সব প্রস্তুতি শেষে আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু করতে পারলে পরের পাঁচ বছরে তা শেষ করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
সূত্র : বিডিনিউজ