রফিকুল ইসলাম সুফিয়ান »
ফারিন এবং ফাহিদ দুজন খুবই উত্তেজিত। কারণ, এখনই তারা দেখতে যাচ্ছে ‘গ্লাসভূতের পানিপান’ ম্যাজিকটি। আর এটি দেখাবে সবার প্রিয় হাবুল মামা।
অনেকটা সারপ্রাইজ দিয়েই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাবুল মামা চলে আসে তাদের বাসায়। মাঝেমধ্যেই এমনটি করে থাকে হাবুল মামা। মামাকে পেয়ে ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। হাবুল মামার সাথে দারুণ আনন্দে কাটে তাদের দিনগুলো।
হাবুল মামা দেশবিদেশের গল্প, রূপকথার গল্প, ভূতের গল্প বলা থেকে শুরু করে নানারকম ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে ।
আগামী দু’দিন স্কুল বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার চাপ নেই। ফারিনই প্রথম মামাকে ম্যাজিক দেখানোর আবাদার করেছিল। হাবুল মামা তো এসবের জন্যে একপায়ে খাড়া। ম্যাজিক দেখানোর জন্যে মামার প্রয়োজন একটি থালা, একগ্লাস পানি,একটি মোম এবং একটি দেশলাই। ফারিন ঘর থেকে এসব এনে দেয় মামাকে।
মামা ফারিন আর ফাহিদকে জিজ্ঞেস করে, ‘গ্লাস ভূতের পানিপান ম্যাজিক’ দেখে ভয় পাবি না তো তোরা?” ফাহিদ বলে,ভূতকে আমি ভয় পাই না। ফারিন আপু ভূতকে খুব ভয় পায়!” এতে ফারিন রেগে গিয়ে ফাহিদকে বলে,”ভূতকে আমি ভয় পাই না। অনেক বড় হয়ে গেছি আমি। ক্লাস ফোরে পড়ি। তুই পড়িস মাত্র ক্লাস ওয়ানে। পুঁচকে ছেলে একটা। ভূতকে ভয় পাস তুই। মাকে ছাড়া তো রাতে একা ঘুমাতে পারিস না।’
ভাইবোনের ঝগড়া থামাতে মামা বলে,”ঝগড়া বন্ধ করে তোরা এখন আমার কথা শোন।” মামা একবার ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে,”রাত দশটা বেজে গেছে। আমি যে ভূতকে নিয়ে ম্যাজিক করবো, সেটি এখন ঘরের পেছনে হাঁটাহাঁটি করছে।”
মামার কথা শুনে ফারিন এবং ফাহিদ আস্তে আস্তে মামার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। দুজনেই কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তারা যেন সত্যিসত্যিই ভূতের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
হাবুল মামা বলতে শুরু করে,”জানিস তো ভূতকে খালি চোখে দেখা যায় না। বাতাসের সাথে মিশে থাকে ওরা। এই ম্যাজিকে ভূত যখন গ্লাসের ভেতর পানি পান করবে, তখন ভূতকে হালকা ধোঁয়ার মতো দেখাবে। সাবধান! তখন কিন্তু গ্লাসে হাত দিতে যাবি না; এতে বড়রকমের বিপদ ঘটে যেতে পারে।”
‘আমরা গ্লাসে হাত দেব না মামা। তুমি ম্যাজিক শুরু করো।’ একই সাথে জবাব দেয় দুজন।
‘তোরা সবাই ভালো করে লক্ষ্য কর। আমি ম্যাজিক শুরু করতে যাচ্ছি।’ বলেই প্রথমে মামা টেবিলের উপর প্লেটটা রেখে, দেশলাই জ্বেলে মোমটাতে আগুন ধরিয়ে নেয়। তারপর মোম গলতে শুরু করলে দুতিন ফোঁটা গলিত মোম প্লেটের ঠিক মাঝখানে ফেলে তার উপর জ্বলন্ত মোমটা দাঁড় করিয়ে রাখে। এবার গ্লাসের সবটুকু পানি সাবধানে ঢেলে দেয় প্লেটে। ফারিন এবং ফাহিদ দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সব। কিছুটা ভয়ও করছে। যদি কিছু ঘটে যায়!
এবার মামা বলতে শুরু করে,”এক্ষুনি তোরা গ্লাসভূতের পানিপানের দৃশ্যটি চোখের সামনেই দেখতে পাবে। মন্ত্র পড়ার সাথেসাথেই ভূত এসে পানি পান করবে।” এটুকু বলেই মামা মন্ত্র পড়তে শুরু করে,
‘হিংটিং ছট
কটরমটর কট।
খিটিরমিটির খিট
চক্ষু পিটিরপিট;
গাইছি ভূতের গান,
করতে হবে প্লেটের পানি পান।
মন্ত্রপড়া শেষ করেই মামা খালি গ্লাসটি উপুড় করে খুব সাবধানে জ্বলন্ত মোমটিকে পানির উপর ঢেকে দেয়।
মোমটি ঢেকে দিয়েই মামা আবার বলতে থাকে,
‘যা ঢুকে ভূত গ্লাসের ভেতর
পান করে এই পানি,
দে দেখিয়ে খ্যাংরা ভূতের
শক্তি কতোখানি।
করিস না তুই ক্ষতি কারো
রাখবি কথা মনে,
তারপরে ঠিক ইচ্ছে হলে
যাস চলে দূর-বনে।”
ফারিন এবং ফাহিদ অবাক চোখে দেখে—গ্লাসের ভেতর মোম জ্বলছে আর প্লেটের পানি আস্তে আস্তে গ্লাসের ভেতর উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। পানির উপরে উঠে যাওয়া দেখে আনন্দে হাততালি দেয় ফারিন ও ফাহিদ। বেশখানিকটা পানি উঠে যাওয়ার পর মোমবাতিটা নিভে যায়। এখন গ্লাসের ভেতর হালকা ধোঁয়া আর উপরে উঠে যাওয়া পানিটুকু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্লেটের পানির লেবেল থেকে গ্লাসের ভেতর পানির লেবেল অনেকটা উপরে উঠে গেছে।
এবার মামা ফারিন এবং ফাহিদকে লক্ষ্য করে বলে,”বল দেখি, ভূতের পানিপান কেমন দেখলি?’
‘ভূতের পানিপান স্পষ্ট দেখেছি মামা। কিন্তু গ্লাসটা তুলে নিলে ভূতটা কোনো ক্ষতি করবে না তো?’ কথাগুলো বলেই মামার দিকে তাকায় ফারিন।
মুচকি হেসে মামা বলে,”ভয় পাচ্ছিস ক্যান? এই হাবুল মামা কাছে আছে না তোদের!’
ফারিন আর ফাহিদের বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছে না। বিস্মিত ফারিনবলে, ‘মামা, এই প্রথম ভূতকে পানিপান করেতে দেখলাম।’
ফারিনের কথা শেষ হতে না হতেই ফাহিদ জানতে চায়,”মামা, ভূত তো আমাদের দেখে ফেলেছে। একা পেলে কিছু করবে না তো!”
ফাহিদ এবং ফারিনের কাঁধে হাত রেখে মামা বলে,”এসব নিয়ে ভাবিস না তো। ভূত কিচ্ছুটি করতে পারবে না। ভূতই মানুষকে ভয় পায়।
এবার বল আগে, ম্যাজিকটা কেমন লাগলো?”
ফারিন এবং ফাহিদ মামাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘দারুণ ম্যাজিক দেখিয়েছো মামা। সত্যিই তোমার তুলনা হয় না!’
খুশি হয়ে মামা বলে বলে,”ম্যাজিকটা তোদের ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে। আরো অনেক ম্যাজিক আছে। অন্যসময় দেখাবো সেগুলো। এবার বল দেখি ম্যাজিকটা কি তোদের শিখতে ইচ্ছে করে না!’
খুশিতে লাফিয়ে উঠে ফারিন এবং ফাহিদ। ‘তুমি ম্যাজিক শেখাবে মামা?’ ফারিনের প্রশ্ন। ‘অবশ্যই শেখাবো। আমার দুটো আদরের ভাগনে-ভাগনীকে শেখাবো না তো কাকে শেখাবো! ম্যাজিক শেখানোর আগে কিছু বিষয় জানা দরকার। তোরা তো জানিস বাতাসে অক্সিজেন থাকে। তাই না?’ মামার প্রশ্ন।
ফারিন জবাব দেয়, ‘খুব জানি। অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণীই বাঁচতে পারে না।’ ফারিনের জবাবে মামা বলে, ‘ঠিক বলেছিস। তোরা তো অনেক কিছু জানিস দেখছি। আরেকটি কথা বলি, অক্সিজেন ছাড়া কিন্তু আগুনও জ্বলে না। সেই সাথে মনে রাখবে, বাতাস প্রত্যেকটি বস্তুর উপর চাপ প্রয়োগ করে থাকে। বড় হলে এ ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে তোরা।’
ফাহিদের আর তর সয় না। ‘ম্যাজিক কখন শেখাবে মামা?’ ফাহিদের প্রশ্নে মামা বলে, আর অপেক্ষা নয়।এবার শেখাচ্ছি ম্যাজিক। যে কথাগুলো এখন বলেছি তার সাথে এই ম্যাজিকের সম্পর্ক আছে। তোরা তো দেখেছিস, ম্যাজিক দেখানোর সময় খালি গ্লাস দিয়ে জ্বলন্ত মোমটিকে ঢেকে দিয়েছি। তাই না?। ‘দেখেছি মামা।’ দ্রুত জবাব দেয় ফাহিদ।
ফারিনও বলে উঠে, ‘গ্লাসটি ঢেকে দিয়ে তুমি মন্ত্র পাঠ করতেই ভূত গ্লাসে ঢুকে পানি পান করতে শুরু করে। ঠিক বলিনি মামা?’
মামা শুরু করে, ‘ঠিক বলেছিস। এবার বলছি আসল রহস্য। গ্লাস দিয়ে যখন জ্বলন্ত মোমটিকে ঢেকে দিই, তখন মোমটি কিছুক্ষণ জ্বলেই নিভে যায়। আর এই সময়ের মধ্যেই পানি গ্লাসের ভেতর ঢুকতে শুরু করে। বলতে পারিস মোমটি নিভে যায় কেন?’
ফারিন এবং ফাহিদ দুজনেই একসাথে জবাব দেয়, ‘ঠিক বলতে পারছি না মামা! তুমিই বলে দাও।’
‘শোন তবে। আমি আগেই বলেছি, অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলতে পারে না। এখানেও তাই হয়েছে। গ্লাস দিয়ে জ্বলন্ত মোমবাতিটি ঢেকে দেয়ার পর গ্লাসের ভেতর যে পরিমাণ বাতাস ছিল এবং তাতে যতটুকু অক্সিজেন ছিল, তা পুড়ে শেষ হয়ে যায়। সেই সাথে আগুনও নিভে যায়।’ বলেই মামা একটু থামে।
ফারিনের জিজ্ঞাসা, ‘তারপর কী হলো মামা?’
‘বলছি শোন। আসল ঘটনা এখানেই। অক্সিজেনটুকু পুড়ে যাওয়া শেষ হলে গ্লাসের ভেতর কিছুটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। বাতাস এবং পানির ধর্ম হলো শূন্য জায়গা পূরণ করে ফেলা। যেহেতু গ্লাসের ভেতর বাতাস ঢোকার পথ নেই, তাই বাইরে থেকে বাতাসের চাপে পানি গ্লাসের ভেতর প্রবেশ করে শূন্য জায়গাটুকু পূরণ করে দেয়। এটাই হলো মূল রহস্য।’
মামা থামতেই ফাহিদ বলে,‘তাহলে তুমি যে বললে, ভূতে পানি পান করেছে!’ হাসতে হাসতে মামা বলে, ‘ঠিকই বলেছিস। ভূত-টুথ বলে আসলে কিছু নেই। আমি গ্লাস-ভূতের পানিপান ম্যাজিকের কথা বলে আনন্দের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের এই সত্যটি শেখাতে চেয়েছি তোদের। খুশি হয়েছিস কী না বল।’
ফারিন এবং ফাহিদ দুজনেই মামার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘খুশি হয়েছি মামা, খুব খুশি হয়েছি। দারুণ একটি জিনিস শিখিয়েছো আমাদের। সত্যিই তুমি জিনিয়াস।