শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
উত্তর কাট্টলী এলাকার সুকন্যা নামে এক গৃহিনী বলেন, ‘তিন মাস ধরে টানা ভোগান্তি নিয়ে রান্না-বান্না করছি। গ্যাস বিলের টাকা ঠিক সময়ে দিচ্ছি। কিন্তু রান্নার জন্য দুই-তিন দিন পর পর কেরোসিন আনতে হচ্ছে ১৪০ টাকা দরে। অন্যদিন নিভু নিভু করে যা একটু জ্বলে, আজকেও তাও জ্বলছে না।’ নগরের বেশিরভাগ এলাকায় একই অবস্থা।
-
নগরে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ
-
খাবারের দোকানে দীর্ঘ লাইন
-
সরবরাহ স্বাভাবিক হতে একদিন লাগতে পারে
শীতের সকালে ঘুম থেকে ওঠে এক কাপ চা খাওয়ার সুযোগ পাননি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) প্রায় শতভাগ মানুষ। কেউ রাইস কুকারে সেরেছেন ভাত রান্না আর কেউ জ্বালিয়েছেন স্টোভ। কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই গ্যাস না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন কেজিডিসিএল গ্রাহকরা।
গ্যাস না থাকায় অনেকে খাবারের দোকান, হোটেল- রেস্তোরাঁ ছুটে যান। সেখানেও দীর্ঘ লাইন গেছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় খাবার কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
সকাল থেকে এ সংকটের কথা জানিয়ে বখতিয়ার নামে একজন সিএনজি চালক বলেন, ‘আজকে (শুক্রবার) বন্ধের দিন বলে মানুষের দুর্ভোগ চোখে পড়ছে না। রাস্তায় গ্যাসচালিত কোনো গাড়ি নাই বললেই চলে। ফিলিং স্টেশনে সকাল বেলা লাইন দিয়ে বসে আছি। এদিক-ওদিক যাওয়ার সুযোগ নাই। আর যারা গ্যারেজে গাড়ি রেখেছে, তারা কালকে লাইন ঠিক হলে বের করবে। আজকে (শুক্রবার) যদি অফিস-আদালত খোলা হতো, তেলের গাড়ির জুলুম সহ্য করতে হতো। নয়তো রাস্তায় মানুষের কান্নাকাটি করার অবস্থা হতো।’
যা বলছে কেজিডিসিএল
এই সেবা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাস সরবরাহ হঠাৎ করে বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) রাত ২টা থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
সংস্থাটির বিপণন বিভাগের অপারেশন ও দক্ষিণ বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আমিনুর রহমান বলেন, ‘এলএনজি টার্মিনালে টেকনিক্যাল ফল্টের কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি, দ্রুততার সঙ্গে এ সংকটের সমাধান হবে।’
কি ধরনের টেকনিক্যাল ফল্ট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্পেসেফিকলি ত্রুটি কি তা জানি না। এখানে তো আসলে একটা চেইন আছে। এলএনজি টার্মিনালটা হলো সম্পূর্ণ রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) দায়িত্বে। গ্যাস রূপান্তরিতকরণে আরপিজিসিএল কাজ করলেও সরবরাহের কাজ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। জিটিসিএল চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী গ্যাস ডিসস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (কেজিডিসিএল) মোট ছয়টি বিতরণ সংস্থাকে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। তাই সমস্যা বিষয়ে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়েছে আমরা তা-ই জানি।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি
হঠাৎ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর গতকাল (শুক্রবার) দুপুরে মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি রূপান্তরের একটি ভাসমান টার্মিনালে (এলএনজি এফএসআরইউ) কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত মেরামতের কাজ করছে মন্ত্রণালয়। দেশের অন্যান্য এলাকায় শীতের কারণে গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক তদারক করছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
কারিগরি ত্রুটির খোঁজ
কেজিডিসিএলের মোট গ্রাহকের সংখ্যা ৬ লাখ। এ ছয় লাখ গ্রাহকের দুর্ভোগের কারণ জানতে কথা হয় জিটিসিএলের অপারেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু সরবরাহ দিয়ে থাকি। আর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনকে আমরা প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করে থাকি। আসলে প্রতিদিন নির্দিষ্টভাবে সরবরাহ করা হয় না। এটা রেশনিংয়ের মাধ্যমে সরবরাহ হয়ে থাকে। আর আজকে (শুক্রবার) গ্যাস না থাকার বিষয়টি আমরা জেনেছি। তবে আমাদের পাইপলাইনে কোথাও কোনো সমস্যা নেই। মহেশখালীর পাইপলাইন গতকাল (বৃহস্পতিবার) সামিটের লাইন থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইইবিএল) এলএনজি টার্মিনালে সংযুক্ত করা হয়েছে। এটা এলএনজি টার্মিনালের সমস্যা হতে পারে। আর তা আমাদের জানার কথা নয়।’
উল্লেখ্য, ২ নভেম্বরে সিঙ্গাপুরের ড্রাই ডকে মেইনটেন্যাসের জন্য পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইইবিএল) এলএনজি টার্মিনালটি। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ভাসমান এ টার্মিনালটি স্থাপন করা হয় ২০১৭ সালে। ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার এ টার্মিনালটি স্থাপনের জন্য পাঁচ বছরের পরপর মেইনটেন্যাসের জন্য ড্রাই ডকে পাঠানোর শর্ত দেওয়া হয়। শর্ত মেনে ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট থেকে শুরু হয় এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়। একই শর্তে দেশীয় সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি লিমিটেড (এসএলএনজি) আরও একটি এলএনজি টার্মিনাল বসায়, যা ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে সরবরাহ শুরু করে। এলএনজি টার্মিনালগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডকে (আরপিজিসিএল)।
আরপিজিসিএলের এলএনজি ডিভিশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ কবির বলেন, ‘ইইবিএল এলএনজি টার্মিনালটি রেগুলার মেইনটেইন্যান্স শেষে সিঙ্গাপুরের ড্রাই ডক থেকে ফিরেছে ৬ জানুয়ারি। এরপর থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ওটার টেকনিক্যাল কাজ করা হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি লিমিটেড (এসএলএনজি) থেকেই সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। আমরা ওটা থেকে নিয়মিত ৪৮০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টা পর্যন্ত সামিটের টার্মিনালটি অপারেশনে ছিলো। এরমধ্যে গতকাল (বৃহস্পতিবার) ইইবিএলও পুনরায় অপারেশনে যায়।’
টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটি কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে গ্যাসের কোনো সমস্যা না। ইইবিএলের টার্মিনালটির পাওয়ার প্লান্ট বিকল হয়ে যাওয়ায় আমরা গ্যাসগুলোকে সরবরাহ উপযোগী করতে পারছি না। এখানে যে গ্যাসগুলো আনা হয়, তা মূলত মাইনাস (ঋণাত্মক) ১৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় থাকে। সেটাকে হালকাভাবে হিট দিয়ে আস্তে আস্তে প্রসারিত করে সরবরাহ উপযোগী করা হয়। এখন টার্মিনালের বৈদ্যুতিক সমস্যা থাকায় রূপান্তরের কাজটি আমরা করতে পারছি না।’
পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজ শেষ হতে কেমন সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাওয়ার প্লান্টের কাজ আশা করছি, রাত ৯টার মধ্যে (গতকাল) শেষ হবে। সময় এর কম-বেশিও লাগতে পারে। তবে আজকে রাতের মধ্যে যদি বৈদ্যুতিক সমস্যার সমাধান হয়, তাহলে আমাদের সাপ্লাই শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরও একদিনের মতো সময় লাগতে পারে। কারণ সাপ্লাই অফ হওয়ার পরও কিছু কিছু গ্রাহক অল্প অল্প গ্যাস পাচ্ছেন এবং তারা তা ব্যবহার করে পাইপলাইন পুরোপুরি খালি করে ফেলেছেন।’
দুইটি টার্মিনালে স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গ্যাসের পর্যাপ্ত চাহিদা পূরণে দুইটি টার্মিনাল সচল থাকা দরকার। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী আমাদের পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ড্রাই ডকে পাঠাতে হবে। নতুবা আমদের কাছে কোনো জাহাজও আসবে না। এখন ইইবিএল ড্রাই ডক থেকে ফিরে অপারেশনে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রস্তুতি নিচ্ছে সামিটের টার্মিনালটি। সামিটের টার্মিনালটি ড্রাই ডক থেকে ফিরলে তখন গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এরজন্য মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে।
প্রসঙ্গত, একসময় কুমিল্লার বাখরাবাদ, ফেনী বা সিলেট অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিড হয়ে কেজিডিসিএলে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। দেশের জ্বালানি ঘাটতি মেটাতে ২০১০ সালে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে কেজিডিসিএলকে পুরোপুরি এলএনজি নির্ভর করা হয়েছে। ফলে এলএনজি টার্মিনালের বা সংশ্লিষ্ট পাইপলাইনে কোনো সমস্যা হলে, অন্য জায়গায় সংকট তেমন না হলেও অচল হয়ে পড়ে কেজিডিসিএল।