হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত প্রশংসার প্রকৃত হকদার, যিনি মানুষকে দান করেছেন সৃষ্টির সেরা মর্যাদা। তাঁর পবিত্রতা, যিনি তাঁর অবতীর্ণ কিতাব স্পর্শ করতে পবিত্রতার শর্ত আরোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি তাঁর প্রতি বিশ্বাসী বান্দাদেরকে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও অলিÑআওতাদ’র মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। সে পদমর্যাদাকে নিজ ‘নেয়ামত’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।
আল্লাহ্ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই সৃষ্টি জগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সবার রিয্কদাতা। আমাদের জীবনÑমৃত্যুর মালিক তিনি। কাজেই, তিনি একমাত্র উপাস্য। আমাদের কা-ারী, সুপারিশকারী সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘যাঁরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তাঁরা (পরকালে) সে বান্দাগণের সাহচর্যে থাকবে, যাঁদের প্রতি আল্লাহ্ বিশেষ নেয়ামত দান করেছেন, তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ, অলিÑআওতাদগণ। আর সঙ্গী হিসাবে তাঁরা কতই না উত্তম। (সুরা নিসা : ৬৯) অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো, আর সত্যপরায়ণ ব্যক্তিদের সঙ্গী হয়ে যাও’। (৯:১১৯) অপর একটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজ পরিবারÑপরিজনকে (জাহান্নামের) ওই আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’। (৬৬:৬) ইন্ধন উল্লেখে এখানে দহনের তীব্রতা ও প্রখরতার প্রতি ইঙ্গিত এসেছে। উপরে তিনটি আয়াত শরীফের অনুবাদ পত্রস্থ হল। আয়াতত্রয় যথাক্রমে ১. সুরা নিসার ৬৯তম, ২. সুরা তাওবার ১১৯তম এবং ৩. সুরা তাহরীমের ৬৬তম আয়াত। প্রথমোক্ত আয়াতে আল্লাহ্র নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের সাহচর্য অবলম্বনের নির্দেশ প্রদত্ত হয়েছে। পরবর্তী আয়াতেও অনুরূপ খোদাভীতির পাশাপাশি সত্যাশ্রয়ীদের সাহচর্যের নির্দেশ বর্ণিত। শেষোক্ত আয়াতে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে ও আপনজনদের রক্ষা করতে আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশ দান করা হয়েছে।
মাহে রবিউল আখের’র আজ দ্বিতীয় জুমআ। উপরন্তু মাসটির এগার তারিখ অর্থাৎ পবিত্র ফাতেহায়ে ইয়াযদাহম। বড়পীর, গাউসুল আ’যম, মাহবুবে সোবহানী, কুতুবে রাব্বানী, গাউসে সামদানী, পীরানে পীর, হযরত শাইখ সায়্যিদ আবু মুহাম্মদ আব্দুল কাদের জীলানী (রাদ্বি.)র মহান ওফাত বার্ষিকী। এ উপমহাদেশের তরীকতের আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী মুমিন নরÑনারীর অধিকাংশই ‘ক্বাদেরিয়া’ তরীকায় দীক্ষিত। সাধনার পথে তাঁর রূহানী সন্তান অন্যান্য তরীকার মাশায়েখগণের তরীকত ভিন্ন হলেও সকলেই তাঁর প্রতি অগাধ ভক্তি শ্রদ্ধা পোষণ করেন। আমাদের জন্য যাহেরী শরীয়তের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা ফরয। যে সকল ইবাদত ফরয, তা সম্পাদন করতে হলে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন, মাসায়েল ইত্যাদি জানা অপরিহার্য। হালালÑহারাম সংক্রান্ত জরুরি বিষয় না জানলে হালাল অর্জন, হারাম বর্জনের করণীয় কোন মতে আদায় করা সম্ভব নয়। পবিত্রতার জ্ঞান ছাড়া পবিত্র হওয়া যায় না। পবিত্রতা অর্জন ব্যতিরেকে নামায তো দূরে, মসজিদেও প্রবেশ করা যাবে না। মনে রাখা দরকার যে, শুধু ফরয ইবাদতে কোন বান্দা আত্মার উৎকর্ষ, উন্নতি অর্জন করতে পারে না। হাদীসে কুদসীর নির্দেশনা এটা যে, অতিরিক্ত ইবাদতÑরিয়াযত দ্বারাই বান্দা আল্লাহ্র নৈকট্য ও প্রেমÑভালবাসা অর্জন করতে পারে। আবার আধ্যাত্মিক উন্নতির সাধনায় একজন পূর্ণ সাধক বা মুর্শিদে কামিল’র সান্নিধ্য, সঠিক নির্দেশনা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে জরুরি। এ পথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে সাধনাব্রতী কারো বড়পীরকে উপেক্ষা করার সাধ্য নেই। উপরোল্লেখিত আয়াতসমূহের নির্দেশনার আলোকেই বড়পীর, গাউসে আ’যম শাহিন শাহে বাগদাদের আনুগত্য, আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব, রূহানী সান্নিধ্য, তাঁর ফয়েয ও বরকতের কোন বিকল্প নেই।
বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাদ্বি.) ৪৭০ হিজরীর ১ রমযান, বর্ণনান্তরে ৪৭১ হি. সনে জন্মগ্রহণ করেন। মাহে রমযানের চাঁদ উদয়ের রাত শেষে সুবহে সাদিকের সময় গাউসে পাক পৃথিবীতে তাশরীফ আনেন। তারিখটা ছিল ‘ইয়াত্তমুশ শাক’। শাবানের ২৯ দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা নিশ্চিত হলে তবেই পরদিন ১লা রমযান। তাই দিন সন্দেহপূর্ণ, যদি আকাশ হয় মেঘাচ্ছন্ন তবেই ‘শাক’ বা সন্দেহ পূর্ণমাত্রায়। তখন চাঁদ উদয় নিশ্চিত না হলে রোযাও রাখা যাবে না, উদয় হলে রোযা রাখা ফরয। গাউসে পাকের শুভজন্মেও তাই হলো। আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন। কেউ চাঁদ দেখেনি। কেউ ভাবল পরদিন শাবানের ৩০, কেউ ধরে নিল চাঁদ উঠেছে। সুবহে সাদেকের পূর্বে গাউসে পাক ভূমিষ্ঠ হলেন। অনেকে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে সতর্কতার জন্য রোযা পালনে প্রস্তুত রইলেন। গাউসে পাকের আব্বাজান সময়ের যুগশ্রেষ্ঠ আলেম হযরত সায়্যিদ আবু সালেহ মুসা জঙ্গীÑদোস্ত, যাঁর যুহ্্দ ও তাকওয়ার খ্যাতি জগতজোড়া। সমাধানের আশায় অনেকে তাঁর গৃহে জড়ো হলেন। পথিমধ্যে তাঁদের অনেকে এক দরবেশের মুখে শুনেছেন হযরত আবু সালেহ মুসার কাছে গিয়ে জেনে নাও। তাঁর একজন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে, শিশুটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন হবেন। যদি ওই শিশু সুবহে সাদেকের পর হতে মায়ের দুধ গ্রহণ করে থাকেন, তবে চাঁদের উদয় হয়নি। যদি চাঁদের উদয় সত্যিই হয়ে থাকে, তবে তাঁকে দুধ পান করানো যাবে না। এ খবর চাউর না হতেই অন্দরমহল থেকে নবজাতক’র দুধ না খাওয়ার সংবাদ আসলো। এ ভাবে জন্মগ্রহণের প্রথম প্রহরেই শুধু কারামতই প্রকাশ করেন নি; বরং অনেক রোযাদারের সংশয়, উদ্বেগ দূর করে দিলেন শিশু গাউসুল আ’যম। গাউসে পাকÑএ দুনিয়াতে এসেই কারামত প্রদর্শন করেননি; বরং আলমে আর ওয়াহ্তে, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন, শৈশবে, যৌবনে, পরিণত বয়সে, এমনকি ওফাত পরবর্তী এখন পর্যন্ত তাঁর অগণিত কারামত প্রদর্শিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। ‘বাহ্জাতুল আসরার’ গ্রন্থে শাইখ আল্লামা নুরুদ্দীন আবুল হাসান শাতনূফী (রহ.) গাউসে পাকের উক্তি লিপিবদ্ধ করেন, যাতে তিনি বলেন, ‘আমার পালনকর্তার কসম, লওহে মাহ্ফুযে লিপিবদ্ধ সমস্ত সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগাদের আমার দৃষ্টির সামনে পেশ করা হয়’। বাগদাদের যমীনে বসে লাওহে মাহ্ফুয প্রত্যক্ষ করার মত ক্ষমতা আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে দান করেছেন। আল্লামা রূমী (রহ.) তাঁর মসনভীতে লিখেছেন, ‘লাওহে মাহ্ফুয হাস্ত পেÑশে আওলিয়াÑ আঁ চেহ্ মাহফুয আস্ত্ মাহফুয আয খাত্বা’। অর্থাৎ লাওহে মাহ্ফুয আউলিয়া কেরামের দৃষ্টির সামনে থাকে। (তাঁদের দৃষ্টি এতটাই প্রসারিত ও প্রখর) আর লাওহে মাহ্ফুযÑএ যা লিপিব্ধ, তা ভুলÑভ্রান্তি হতে মুক্ত।
ইবনে নাবাতা প্রণীত খুৎবার এ সংখ্যায় লিপিবদ্ধ এক হাদীসে বলা হয়েছে ‘আমলবিহীন আলেম বৃষ্টিহীন মেঘের মত। দানশীলতাহীন ধনী ফলহীন বৃক্ষের মত। ধৈর্যহীন ফকীর জলবিহীন সাগরের মত। ন্যায়বিচারহীন রাজা রাখালবিহীন ছাগলের মত। তাওবাহীন যুবক ছাদবিহীন গৃহের ন্যায়। লজ্জাহীন নারী স্বাদহীন আহার্যের ন্যায়’।
গাউসে পাকের বংশীয় আভিজাত্য অতুলনীয়। বাবার ও মায়ের উভয় বংশের ধারায় তিনি হাসানী ও হুসাইনী। নবী বংশীয় বলে বংশকৌলিন্যেও তিনি শ্রেষ্ঠতম। তাঁর সততায় একদল দস্যুর ভাবান্তর ঘটে। তারা অপরাধবৃত্তি থেকে তাওবাÑরিয়াযত করে পরে আল্লাহ্র ওলীতে পরিণত হন। সে দস্যুদলে তারা ৬০ জন ছিল। তাঁদের সর্দারের নাম আহমদ বদভী। (কারামতে গাউসুল আজম) মায়ের অনুমতিক্রমে পারস্যের জিলান থেকে গাউসে পাক উচ্চ শিক্ষা অর্জনে ইরাকের বাগদাদ অভিমুখে আসার পথেই কাফেলাসহ দস্যু আক্রান্ত হন। আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে তিনি একদল ডাকাতকে দরবেশ বানাতে সক্ষম হন। তাঁর হাতেই এরা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এভাবে ১৮ বছর বয়সে তাঁর হাতে সত্যের ঝা-া উড্ডীন হয়।
গাউসে পাকের জ্ঞানÑসাধনা অবর্ণনীয়। রিয়াযতÑমুজাহাদায় তিনি কিংবদন্তী। বাগদাদের বিশ্বখ্যাত প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মাদরাসায়ে নেজামিয়ার অধ্যয়নকালে তিনি বর্ণনাতীত কষ্ট করেন। তাঁর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শেষ হচ্ছে ‘একাধারে চল্লিশদিন খাদ্যাভাবে ক্ষুধা নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে পারস্য স¤্রাটের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষে হালাল কিছুর সন্ধান করছিলাম’। সেখানে দেখলাম সত্তরজন অলিÑআওতাদ খাদ্যের খোঁজে। লজ্জায় ফিরে এলাম। বাগদাদে এক অপরিচিত লোক খোঁজ নিয়ে আমার নিকট আসলে তিনি আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, এগুলো আপনার মা আমার মারফৎ দিয়েছেন। আমি নিজের জন্য কিছু রেখে বাকি টাকা ওই সত্তরজন অলির মধ্যে বণ্টন করে দিলাম’। (প্রাগুক্ত, তাঁর কাসীদায় আছে, ইল্ম অর্জন করে আমি কুৎবিয়ত অর্জন করি। এ পরিসরে তাঁর কোন দিকই যথার্থ বর্ণনা করা অসম্ভব, শুধু স্মরণের জন্যই এ প্রয়াসটুকু।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।