খুনের সুযোগ ২ বছর ধরে খুঁজছিলেন বাবুল

অভিযোগ মিতুর বাবার

সুপ্রভাত ডেস্ক »

মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে মাহমুদা আক্তার মিতুর বাবা দাবি করেছেন, বাবুল আক্তার স্ত্রীকে হত্যার দুই বছর আগেই ছক এঁটে সুযোগ খুঁজছিলেন। এমন সন্দেহের কথা মিতু হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের আগেও জানিয়েছিলেন বলে জানান তিনি; যদিও সাত বছর আগে হত্যাকা-ের পর জামাতার পক্ষে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল তাকে।

মিতুর বাবার তখনকার বক্তব্য এবং এখনকার বক্তব্যের ফারাক তুলে ধরে আসামি পক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মিতুর বাবাকে এমন সাক্ষ্য দিতে ‘বাধ্য’ করা হয়ে থাকতে পারে। আলোচিত এই খুনের বিচারে চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন মামলার প্রথম সাক্ষী মোশাররফ হোসেন। গত ৯ এপ্রিল সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। সেদিন সাক্ষ্যগ্রহণ অসমাপ্ত ছিল। সোমবার তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্য দেন। এক সময়ের পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ প্রথম দিনের সাক্ষ্যে বলেছিলেন, বাবুল কক্সবাজার পুলিশে কর্মরত অবস্থায় বিদেশি নাগরিক এক নারী এনজিওকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মিতু তা জানতে পারার পর তা নিয়ে দাম্পত্য কলহও হয়েছিল। সোমবার মোশাররফ বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদান যাওয়ার আগেই স্ত্রী মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত ছিলেন পুলিশের তৎকালীন এসপি বাবুল। মিতু খুন হন ২০১৬ সালের ৫ জুন। সেই হিসেবে খুনের ঘটনার দুই বছর আগে পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৫ সালে হজে গিয়েছিলেন জানিয়ে সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেন, ‘ওই সময় বাবুল সম্ভবত মিশনে ছিল। ওই নারী (বিদেশি নাগরিক) মিতুর ফোনে কল করে হুমকি দেয়, তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কারণ তাদের (বাবুল ও ওই নারীর) পরকীয়ার কথা লোকজনকে জানিয়ে মিতু নাকি অপপ্রচার করেছিল।

(মিতু) ফোনে আমাকে বিষয়টি জানালে আমি মিতুকে ওই নারীর কল রিসিভ না করতে বলি। ২০১৬ সালের ১ জুন সকালে মিতু তার ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দেওয়ার সময় এই মামলার আসামিরা মিতুকে হত্যার চেষ্টা করেছিল দাবি করে মোশাররফ বলেন, ‘কিন্তু সেদিন মিতু তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে আসায় তাকে হত্যা করতে পারেনি।’

মিতু খুন হওয়ার ঠিক আগে বাবুল চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার ছিলেন। তিনি বদলি হয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিতে ঢাকায় আসার পর চট্টগ্রামে খুন হন মিতু। মোশাররফ বলেন, ‘বাবুল সম্ভবত ৪ জুন পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করে। পরের দিন বাবুলের ষড়যন্ত্র মোতাবেক আসামি মুসা তার সঙ্গীদের নিয়ে মিতুকে হত্যা করে।’

খুনিদের রক্ষা করতে বাবুল তখন তড়িঘড়ি জঙ্গিদের দায়ী করে একটি হত্যা মামলা করেছিল বলে দাবি করেন মোশাররফ, যে মামলায় এখন আসামি হিসেবে বাবুলেরই বিচার হচ্ছে। সাক্ষ্যে মোশাররফ বলেন, ‘আসামি মুসা বাবুলের পূর্ব পরিচিত ও বিশ্বস্ত সোর্স। হাটহাজারী ও চট্টগ্রামের বাসায় মুসা আসা যাওয়া করত।

বাবুল আক্তার চট্টগ্রামে ডিবি অফিসে কর্মরত অবস্থায় মুসাকে ডেকে মিতু হত্যার নির্দেশনা দেয়। তাছাড়া দু-তিনবার মেট্রোপলিটন হাসপাতালের গলিতে মুসাকে ডেকে নিয়ে মিতু হত্যার বিষয়ে আলোচনা করেন।’

মিতুকে হত্যা করতে অস্ত্র কেনার জন্য টাকা দাবি করে জানিয়ে সাক্ষ্যে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাবুল মুসাকে নগদ ৭০ হাজার টাকা অস্ত্র কেনার জন্য দেয়। বাকি ৩ লাখ টাকা পাথরঘাটার প্রেস মালিক সাইফুল ইসলাম পরিশোধ করে দিবে বলে মুসাকে আশ্বস্ত করে। ‘বাবুল আক্তার মিশনে সুদান যাওয়ার অনুমতি পেলে সুদানে যাওয়ার আগে মুসাকে হত্যার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বাসার আশেপাশে রেকি করতে বলে। এও বলে, বাবুল যে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত তা যেন কেউ জানতে না পারে।’

প্রায় এক বছর মিশনে সুদানে থাকাকালে ২-৩ বার বাবুল আক্তার দেশে এসেছিল জানিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘সেসময় এলেও বাসায় থাকেনি। ফিরে যাওয়ার আগে ২-৩ দিন বাসায় থেকেছে।

আমরা জানতে পেরেছি, ছুটিতে এসে বারবার মুসাকে হত্যার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে। মিশন শেষে দেশে চলে আসার পর ২০১৫ সালের শেষদিকে আবার আসামি মুসার সাথে তার কথাবার্তা হয়।

২০১৬ সালের এপ্রিলে প্রশিক্ষণে বাবুল চীনে গিয়েছিলেন জানিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘ওই সময় মুসাকে বলে, আমি চায়না থাকাকালে মিতু হত্যার কাজটি শেষ করে দিবা। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। তবে বাবুল চায়না থেকে ফেরত আসার পর মুসা জানায়, চেষ্টা করেও কাজটি শেষ করা সম্ভব হয়নি।’

চীনে থাকা অবস্থায় বাবুল ‘জঙ্গিরা বাসা চিনে ফেলেছে’ জানিয়ে মিতুকে নতুন বাসা খুঁজতে বলেছিলেন বলেও জানান মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘বাসা পরিবর্তনের সময় মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল বাবুলের।’ জঙ্গিদের নিয়ে যখন পুলিশ ‘রেড অ্যালার্ট’ দিয়েছিল, তখন বাবুল হত্যাকা- ঘটিয়ে তা জঙ্গিদের উপর চালিয়ে দিতে চাইছিলেন বলে দাবি করেন তার শ্বশুর। তিনি বলেন, তখন বাবুল নিশ্চিত হয়েছে মিতুকে হত্যা করলে জঙ্গিরা করেছে বলে চালিয়ে দিতে পারবে। ২০১৬ সালের ২৩ মে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্দেশে রওনা হয় বাবুল। যাওয়ার আগে মুসাকে বলে যায়, সে ঢাকা থাকালে যেন মিতুকে হত্যা করা হয়। যাতে কেউ তাকে সন্দেহ করতে না পারে।
বাবুল মুসাকে বলেছিল, এসময় হত্যা করলে জঙ্গিরা দোষী হবে। আমি হত্যা মামলার তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা হব। খবর বিডিনিউজ।

মিতু হত্যা মামলায় মুসা আসামি হলেও তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তার পরিবারের অভিযোগ, মিতু হত্যাকা-ের পর পুলিশ পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়, তারপর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। পুলিশ অবশ্য মুসাকে আটকের কথা স্বীকার করেনি।

‘আইওদের সব জানিয়েছিলাম’
মিতু হত্যা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ডিবির মো. কামরুজ্জামান, দ্বিতীয় আইও পিবিআই কর্মকর্তা মাঈনুদ্দিন এবং তৃতীয় আইও পিবিআইর সন্তোষ চাকমাকে হত্যাকা-ে বাবুলের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানিয়েছিলেন বলে সাক্ষ্যে দাবি করেন মোশাররফ। তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত আইও’র সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। আইও সন্তোষ কুমার চাকমা ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম সপ্তাহে আমাদের জানায়, তারা তদন্তের শেষ পর্যায়ে। বাবুল আক্তার ও গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছেন। আইও জানান, আমরা মামলার ফাইনাল রিপোর্ট সাবমিট করবো, আপনি এই মামলার বাদি হতে ইচ্ছুক কি না? তখন আমি বলি, পুলিশ মামলা না করলে, আমি নিজেই আমার মেয়ের হত্যাকা-ের বিচার পেতে মামলা করব। পরে ২০২১ সালের ১২ মে মোশাররফ বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুলসহ আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে অবশ্য আদালতের নির্দেশে ওই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এখন বাবুলের করা মামলায়ই বিচার চলছে। সোমবার জবানবন্দি দেওয়ার পর কিছুক্ষণ মোশাররফকে জেরা করেন বাবুলের আইনজীবী। তা শেষ হওয়ার আগেই আদালত ৮ মে পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।

‘ভয় দেখিয়ে এমন সাক্ষ্য’
মঙ্গলবার শুনানি শেষে বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিতুর বাবা সেই ২০১৬ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত গত ৮ বছরে এই মামলা নিয়ে অন্তত ১০ রকমের কথা বলেছেন। উনার কোনো কথার সাথে কোনো কথার মিল নেই। উনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বিভিন্ন রকম স্টেটমেন্ট দিয়েছেন।
‘২০২১ এ উনাকে পিবিআই অফিসে এনে যে অভিযোগটা নেয়া হয়েছে সেই অভিযোগটা পিবিআই কর্তৃক প্রস্তুতকৃত। পিবিআইর কাছে ১২ মে ২০২১ এ যে মামলা করেছিলেন, আবার আজকে দুই বছর পর উনি সেই গল্প থেকে চলে গিয়ে নতুন গল্পের ‍সৃষ্টি করেছেন। উনি কোনো বক্তব্যে অটুট থাকেন না। উনার কোনো বক্তব্যের সাথে কোনো বক্তব্যের মিল নেই।’ আইনজীবী কফিল ‍উদ্দিন বলেন,‘উনি (মোশাররফ) আজকে বাবুল আক্তারকে যেভাবে দায়ী করে কথা বলছেন, ঠিক একইভাবে ২০১৭-১৮ সালে বাবুল আক্তারকে একদম নির্দোষ বলে এবং সে অন্তত সৎ দক্ষ অফিসার হিসেবে, আইওকে বলেছিলেন। পরবর্তীতে ‍উনাকে অন্যভাবে মিসগাইড করা হয়েছে।
‘উনি ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আইওকে একটা চার পৃষ্ঠার অভিযোগ দিয়ে ভিন্ন কথা বলেছিলেন। বাবুল আক্তারের কথা না, ভিন্ন কারণে তার মেয়েকে খুন করা হয়েছে বলে অনেক কথা বলেছিলেন। যেগুলোর সাথে বাবুল আক্তার বা এই নারীকে নিয়ে যে গল্প চলছে সেই গল্পের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। উনি একেক সময় একেক গল্প বলেন, এগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়।’

কেন তাহলে মোশাররফ সাক্ষ্যে এমন বক্তব্য দিলেন বলে মনে করেন- জানতে চাইলে আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ধারণা, বাবুল আক্তার একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। দক্ষ ও সৎ অফিসার হিসেবে ‍উনি নানা জায়গায় হস্তক্ষেপ করেছেন, যেখানে অনেক বড়লোকের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। ‘সেই স্বার্থে আঘাত লাগা বড়লোক, সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং চাকরি জীবনে তার সাথে যাদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ছিল, তারা মিলে একটা চক্র হয়ে বাবুল আক্তারের শ্বশুরকে কোনো ধরনের ভয় দেখিয়ে উনাকে রাজি করিয়েছে, বাধ্য করেছে।’

এনজিওকর্মী নারীর বিষয়টি কাল্পনিক দাবি করে বাবুলের আইনজীবী বলেন, ‘এগুলো যারা তাকে (মোশাররফ) এনে এফআইআর নিয়েছে, তাদেরই সৃষ্টি। ওই নারীর নামের কিছু নাই। বাবুল আক্তারের লেখাগুলোও তাকে তিনদিন আটকে রেখে তার থেকে নিয়েছে। এগুলো সব পিবিআই অফিসে সৃষ্টি চট্টগ্রামে।’