খাগড়াছড়িতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিহত ৩

তিন জেলায় শনিবার থেকে ৭২ ঘন্টার অবরোধ

বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয় | ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »

বৃহস্পতিবার বিকালে জেলার দীঘিনালায় লারমা স্কয়ারে দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে দুর্বৃত্তরা বাজারে আগুন দিলে অর্ধ শতাধিক দোকানপাট পুড়ে যায়। একই ঘটনার জেরে গতকাল রাতে জেলা সদরের স্বনির্ভর ও নারানখাইয়া এলাকায় গুলিতে ৩জন নিহত এবং ৯ জন আহত হয়েছেন।

নিহতরা হলেন- জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। নিহতদের মধ্যে জুনান চাকমা ও রুবেল চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ি সদরে এবং ধনঞ্জয় চাকমার বাড়ি দীঘিনালায়। এর মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে মারা যান। অপর দুজনকে আহত অবস্থায় রাতে খাগড়াছড়ি সদর থেকে হাসপাতালে আনা হয়।

বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলাসদর ও দীঘিনালায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিহত তিনজনের মরদেহ পোস্টমর্টেম শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলাজুড়ে ভয়-আতঙ্ক কাটাতে মাঠে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন, জেলা প্রশাসকসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাড়ানো হয়েছে সেনাবাহিনী এবং বিজিবি’র টহলও। জেলাশহরে দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বলবৎ ছিলো ১৪৪ ধারা।

তথ্যমতে, খাগড়াছড়িতে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার দীঘিনালায় ও খাগড়াছড়ি সদরে পরস্পর বিরোধী সহিংসতায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০ জন আহত হবার পাশাপাশি দীঘিনালায় হিংসার আগুনে পুড়েছে পাহাড়ি-বাঙালি মালিকানাধীন শতাধিক দোকানপাট। লুটপাট এবং ভাংচুর হয়েছে বেশকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ধন রঞ্জন চাকমা (৫০) গত বৃহষ্প্তিবার দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আহত হয়ে খাগড়াছড়ি জেলাসদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে । একই দিন রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নারানখাইয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০) দুই যুবক ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে। এই হত্যাকান্ডের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’-এর পক্ষ অভিযুক্ত করা হলেও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তা নাকচ করা হয়েছে।

এদিকে শুক্রবার সকাল ১১টা নাগাদ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান এবং জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল সরেজমিনে দীঘিনালার সংঘাত ও অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

খাগড়াছড়ি আধূনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রিপল বাপ্পি চাকমা তিনজন নিহতের লাশ বিকেল নাগাদ পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে পাঁচজন এখন জেলাসদর হাসপাতালে এবং চারজনকে আশঙ্কাজনক বিবেচনায় চমেক হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। তিনি জানান,এর মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয় অপর দুইজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যায়।

খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি বাতেন মৃধা জানিয়েছেন, নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় খাগড়াছড়ি এখন পর্যন্ত কোন মামলা বা কেউ আটক হননি। একই সাথে দীঘিনালা থানার ওসি নুরুল হকও জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবারের সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোন মামলা বা আটকের খবর নেই।

বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের জেরে সন্ধ্যার পর থেকে পানছড়িসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার অবরোধ করে পাহাড়ি ছাত্র-যুবকরা কোথাও কোথাও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর উপর চড়াও হয়। পানছড়িতে বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে জেলা সদরের নারানখাইয়া ও স্বনির্ভর এলাকায়, মুহুর মুহু গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।

বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা নাগাদ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান, দীঘিনালা জোনের অধিনায়ক লে: কর্ণেল ওমর ফারুক ও পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েলকে সাথে নিয়ে দীঘিনালার সংঘাতপূর্ণ এলাকা সরেজমিন পরিদরশন করেন। এরপর তিনি জেলাসদর হাসপাতালে নিহত ও আহতদের খোঁজখবর নেন। এরপর তিনি বিকেল চারটায় তাঁর সম্মেলন কক্ষে বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জানান, নিহতদের পরিবারের জন্য সরকারিভাবে সহযোগিতা প্রদান করা হবে। আহতদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রশাসন পাশে থাকবে। দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।

তিনি জানান, বুধবার দিবাগত রাতে গণপিটুনিতে নিহত মামুনের ঘটনা থেকে অগ্নিসংযোগে যারা যারা জড়িত তা তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

দীঘিনালা জোনের অধিনায়ক লে: কর্ণেল ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার রাত আটটা থেকে সেনাবাহিনী বিজিবি ও পুলিশকে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে। সাজেকমুখ পর্যটকরা যেমন আসা-যাওয়া করছে, তেমনি দোকানপাটও খুলেছে। পাহাড়ি-বাঙালি সবার জীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্টে হোল্ডারদের সাতে মতবিনিময় চলছে।

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, সবাই নিজ নিজ ভুলভ্রান্তি মেনে এক সাথে অভিন্ন মানসিকতায় চললে আর কোন সমস্যা হবে না।

তিন জেলায় শনিবার থেকে ৭২ ঘন্টার সর্বাত্মক অবরোধের সমর্থনে ইউপিডিএফ’র বিবৃতি:

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন ও বিহার-ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’-এর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নতুন কুমার চাকমা।

এছাড়া দলটি ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) ৭২ ঘন্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে।

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি হামলাকে বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক উল্লেখ করে বলেন, বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদরের লারমা স্কোয়ারে মিছিল সহকারে এসে বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং দোকান-ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করে।

বিবৃতিতে এ সময় বাঙালিদের হামলায় গুরুতর আহত ধন রঞ্জন চাকমা (৫০) খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে মারা যান। এছাড়া আরো বেশ কয়েকজন আহত হন।

অন্যদিকে, দীঘিনালার উক্ত হামলা-অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে রাতে খাগড়াছড়ি সদরের নারাঙহিয়া, উপালি পাড়া ও স্বনির্ভর এলাকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে নিরাপত্তা বাহিনী নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে জুনান চাকমা (২২) ও রুবেল ত্রিপুরা (২৪) নামে দু’জন নিহত হন এবং ১২ জনের অধিক গুরুতর আহত হন।

আহতদের মধ্যে গুরুতর জখম ৭ জনকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯ জন ছাত্র ও সাধারণ লোককে আটক করে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে আহত অবস্থায় থানায় হস্তান্তর করেছে।

ইউপিডিএফ নেতা অবিলম্বে পাহাড়িদের ওপর হামলা, ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত এবং আহত-নিহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।