সুপ্রভাত ডেস্ক »
লাল জাম্পার পরা এক শিশু খেলছে মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহতে অবস্থিত এক শরণার্থী শিবিরে। তার পরিবারের রমজানের শুরু হয়েছে এখানে থাকা তাঁবুতে বসবাসের মধ্য দিয়েই। শিবিরটিতে শত প্রতিবন্ধকতা ও অনিশ্চয়তার মাঝেও রমজানকে হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছেন তারা।
শিবিরের শরণার্থীরা রমজানে যথাসম্ভব তাঁবুর আশপাশ সাজিয়েছেন। প্রতিবছর রোজার সময় ঠিক যেমনটা করা হতো নিজেদের বাড়িতে। শিশুদের জন্যও এটি ছিল বেশ স্বাভাবিক আচার। কিন্তু একের পর এক ইসরায়েলি হামলার কারণে গাজা বর্তমানে যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তাই এবারের রমজান উপত্যকাটির জন্য মোটেও সুখকর নয়।
সিএনএনকে ফিলিস্তিনিরা জানান, চলমান যুদ্ধ রমজানের মতো একটি শান্তিপূর্ণ মাসের সকল উৎসব ও প্রার্থনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। অনেকেই এই বাস্তবতাও মেনে নিয়েছেন যে, এবার ইফতার করার জন্য পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যাবে না। কেননা ইসরায়েলের আরোপিত চলমান অবরোধের কারণে গাজায় খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে গাজার উত্তরাঞ্চলে খাদ্য সংকট যেন চরমে পৌঁছেছে। সেখানে বহু গাজাবাসীর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাবার ও পানি থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে শুধু রমজানের কারণে নয়। বরং তাদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার নেই সেই কারণেও।
ক্ষুধার জ্বালায় শিশুরা মরিয়া হয়ে আবর্জনার মাঝে ফেলে দেওয়া খাবার খুঁজছে। আর উপত্যকাটির দক্ষিণাঞ্চল রাফাহতে ফিলিস্তিনিরা সম্ভাব্য ইসরায়েলি স্থল হামলার হুমকিতে আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন। যদিও বেশিরভাগ বেসামরিক লোক তেল আবিবের বোমাবর্ষণ থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে।
বাস্তুচ্যুত হয়ে রাফাহ সীমান্তে অবস্থান নেওয়া ২৬ বছর বয়সী সাংবাদিক আসিল মুসা বলেন, আমরা রমজানের জন্য অপেক্ষা করি কারণ এটি আশীর্বাদ, শান্তি ও ইবাদতের মাস। কিন্তু এবারের রমজান এসেছে গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের মাঝে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আচমকা আক্রমণ করে হামাস। এতে ১২০০ জন নিহত হয়; প্রায় ২৫০ জনকে বন্দী করে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গ্রুপটি।
এর পালটা জবাব হিসেবে গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এতে উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে, এখন পর্যন্ত ৩১ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের ৭২ ভাগই নারী ও শিশু। এছাড়াও আহত হয়েছে প্রায় ৭১ হাজার।
এক শিশু চিকিৎসক সিএনএন-কে জানান, চলমান হামলায় নবজাতকসহ প্রায় ২৭ জন মানুষ খাবারের অভাবে মারা গেছেন। এরমধ্যে রমজানের প্রথম দিনে দুইজন অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যায়।
যদিও ইসরায়েলের জোর দাবি, গাজায় ‘যত ইচ্ছা তত’ ত্রাণ প্রবেশ করতে পারে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ত্রাণবাহী ট্রাকে নজরদারির মানে হচ্ছে খুব অল্প পরিমাণ ত্রাণই অঞ্চলটিতে প্রবেশ করতে পারছে।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলি সতর্ক করেছে যে, গাজায় রমজান উপলক্ষ্যে পরিবারগুলি খাবারের গুরুতর ঘাটতিতে রয়েছে। একইসাথে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও মানসিক দুরবস্থার কারণে তারা এক নতুন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
রাফাহ শহরের বাস্তুচ্যুত স্বাস্থ্যকর্মী মোহাম্মদ হামুদা সিএনএনকে বলেন, আমাদের অনেক বন্ধু ও প্রিয়জন ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবন্ত চাপা পড়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে মারা গেছে। অন্যরা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অত্যন্ত কঠিন সময় যাচ্ছে। আমরা এখনও বেঁচে আছি বলে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে।
রাফাহর রাস্তা দিয়ে গাজার ছেলে-মেয়েদের নানা লেখা সম্বলিত আহ্বান নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। তাদের মাঝে থাকা একটি শিশু ইংরেজিতে লিখেছে, আমাদের প্রতিদিনের মৃত্যু বন্ধ করুন।
রাসমি আবু আল-আনিন নামের ৫২ বছর বয়সি এক বিক্ষোভকারী গত ৬ মার্চ সিএনএনকে বলেন, গাজার শিশুরা রমজানে রোজা, প্রার্থনা, ফানুস নিয়ে খেলা, আনন্দ ও ঈদের জন্য অপেক্ষা করত। তবে এবার রমজান আসার সাথে সাথে আমরা বিমান, ড্রোনের হামলা এবং হুমকি ও ভয়ভীতি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। এই মৃত্যু আর কতদিন চলবে?
এমনকি গাজাবাসীরা রমজান মাসের প্রার্থনাগুলোও ঠিকঠাক করতে পারছেন না। গত সোমবার রাফাহ শহরের পূর্বে আল-জুনাইনা পাড়ায় একটি বাড়িতে বিমান হামলায় অন্তত তিন নারী নিহত হয়েছেন।
সাংবাদিক আহমাদ হিজাজি সিএনএনকে বলেন, আল বারাকাত পরিবারের সদস্যরা যখন সেহরি খেতে জেগেছিল ঠিক তখনই বোমা হামলা করা হয়।
যদিও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, সোমবার ইসরায়েলের বাহিনী দক্ষিণ গাজার হামাদ এলাকায় ‘লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান’ শুরু করেছে।
চলতি মাসে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যেকার যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে। এক্ষেত্রে রাফায় ইসরায়েলি স্থল আক্রমণের আশঙ্কা পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। তাই আপাতত গাজাবাসীদের জন্য কোনো স্বস্তির সংবাদ নেই।
তিন সন্তানের বাবা হামুদা সিএনএনকে স্থল হামলার হুমকি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমাদের ভয় পাচ্ছি। কেননা আমরা নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ। আমরা চাই আমাদের সন্তান আমাদের সামনে বড় হোক। তবে আমরা প্রিয়জন ও জন্মভূমি হারানোর আশঙ্কায় সবচেয়ে বেশি ভীত।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১৭ লাখ গাজাবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যাদের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ যারা রাফাতে আশ্রয় নিয়েছে।
শরণার্থী হিসেবে অনেক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি স্যানিটেশনের ন্যূনতম সুবিধা পাচ্ছে না। আর বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় খাদ্যের দাম বেড়েছে।
গাজায় বসবাসরত পিতামাতারা সিএনএনকে জানান, তারা না খেয়ে থাকছেন যাতে তাদের বাচ্চারা সামান্য কিছু খেতে পারে।
সেক্ষেত্রে হামুদা জানান, তিনি তার ছোট বাচ্চাদের বোঝাতে পারছেন না যে, এই রমজানে কেন ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি খাবার খাওয়া হচ্ছে না কিংবা তিনি উপহার দিতে পারছেন না।
জিহাদ আবু ওয়াতফা নামের এক গাজাবাসী বেত লাহিয়ার ধুলোময় রাস্তায় সাইকেল চালান। সেখানে তিনি ক্ষুধার্ত শিশুদের খাবারের জন্য হাহাকার করতে দেখেন। কিন্তু তিনি চাইলেও তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন না।
২৭ বছর বয়সী ওয়াতফা সিএনএন-কে বলেন, ধনী, গরীব নির্বিশেষে কারো আটা কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। কারণ তাদের কাছে ততো টাকাই নেই। সেক্ষেত্রে বাচ্চারা অনেক সময় আবর্জনার মাঝে খাবারের সন্ধান করছেন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেওয়া ঐ সাক্ষাৎকারে ওয়াতফা আরও বলেন, ইতোমধ্যেই এমন অনেক লোক আছেন যারা রোজা রাখার মতো না খেয়ে আছেন।
গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থানকৃত বাসিন্দারা যেন খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছেন। এখানেই যুদ্ধের প্রথম দিকে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি হামলা চালিয়েছে।
ঐ অঞ্চলের ফিলিস্তিনিরা সিএনএনকে জানায়, তারা ভেষজ খাবার, কাস্টার্ড কিংবা ছোট ছোট বিস্কুটে পানি মিশিয়ে স্যুপের মতো করে খাচ্ছেন। কেননা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার থেকে তারা বঞ্চিত।
এদিকে ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকেরা সাহায্য পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি গাজায় ত্রাণ বিতরণকালে ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালানোর পর কমপক্ষে ১১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দা করা হয়েছে।
এদিকে ত্রুটিপূর্ণভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণেরও অভিযোগ উঠেছে। গত শুক্রবার গাজার পশ্চিমে আল শাতি ক্যাম্পে বিমান থেকে ছিটকে যাওয়া ত্রাণ পড়ে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার সাংবাদিক খাদের আল-জানউন এটি নিশ্চিত করেছেন।
মানবিক সংস্থাগুলিও এর আগে গাজাবাসীর নিকট ত্রাণ বিতরণের পন্থাকে অদক্ষ ও অবমাননাকর উপায় হিসাবে উল্লেখ করে সমালোচনা করেছিল। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে উপত্যকাটির সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল।
গাজায় সিএনএন-এর জন্য কাজ করা স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল কাদের সাব্বাহ বলেন, ‘লোকেরা ত্রাণ পাওয়ার জন্য একে অপরের সাথে লড়াই করছে। লড়াই করতে হবে বলে আমি সেখানে খাবারের জন্য যাই না।’
এদিকে ২৭ বছর বয়সী আহমেদ জাইদা সিএনএনকে বলেন, ফিলিস্তিনিরা গাজার উত্তরাঞ্চলে গাজা সিটির শেখ রাদওয়ান পাড়ায় গত সোমবার ইফতারে শুধু খেজুর ও মটর খেতে পেরেছিল। মানুষ সকালে বাজারে গিয়ে কেনার মতো কিছু খুঁজে পায় না। এদিকে ইসরায়েলে বোমাবর্ষণে গাজার বহু এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; শত শত মসজিদ ধ্বংস হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসেব মতে অন্তত ১ হাজার মসজিদসহ নানা প্রাচীন স্থাপনা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সিএনএনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ১০০ জনেরও বেশি ইমাম, মুয়াজ্জিন ও হাফেজ নিহত হয়েছেন। খবর টিবিএস।
গাজার বাসিন্দারা সিএনএন-কে জানায়, রাতের তারাবিহ নামাজে অংশ নেওয়ার জন্য তারা পর্যাপ্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি অনেকে পানির অভাবে ওজু করতে পারছেন না।
মুসা বলেন, রমজানে সাধারণত আত্মীয়ের বাড়িতে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ থাকে। কিন্তু আজকাল তারা আলাদা জায়গায় রয়েছে। শেষ কবে আমি ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ ছাড়া আযানের শব্দ শুনেছিলাম মনে নেই।
আন্তর্জাতিক