সংবাদদাতা, আনোয়ারা »
দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার স্বাক্ষী ছিলো ৯১,৯৭ এর তুফানের। এবার নতুন করে স্বাক্ষী হলো নতুন এক দুর্যোগের। টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার রূপ দেখেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ। টানা ভারী বৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয়েছে আনোয়ারার অন্তত ৪০টি গ্রাম। এদিকে বুধবার থেকে ভারী বৃষ্টি বন্ধ হলে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ধীর গতিতে নামতে শুরু করেছে পানি। তবে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। বন্যার পানি নামলেও রেখে যাচ্ছে ক্ষতি। প্লাবিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করলেও রাস্তায় রেখে যাচ্ছে ক্ষত। প্রায় ৭ দিনের বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মৎস্যজীবীদের। এছাড়াও স্রোতে ধসে গেছে বহু বাড়িঘর, গ্রামীণ সড়কের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে গবাদিপশু, পুকুরের মাছ। পানিতে ডুবে ও স্রোতে ভেসে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের।
সোমবার দুপুর ১২টায় উপজেলার রায়পুর গ্রামে বৃষ্টির পানিতে জমে থাকা বিলের পানিতে ডুবে ৪ বছর বয়সের জোবায়ের নামের এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনা হয়েছে। নিহত ঐ শিশু রায়পুর গ্রামের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. সেলিমের ছোট ছেলে। এছাড়াও বুধবার কর্ণফুলী নদীর ১৫ নম্বর সিইউএফএলের জেটির নিচ থেকে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে লাশটি উদ্ধার করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন কর্ণফুলী থানার রাঙ্গাদিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রেজাউল হোসেন। শুক্রবার ১১ নম্বর জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের পূর্ব জুইদন্ডী গ্রামের ১নম্বর ওয়ার্ডের (ঘাটঘর) এলাকায় নদী থেকে একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
মৎস্যজীবীদের ১০ কোটি টাকার ক্ষতি টানা বৃষ্টি আর বান্দরবান থেকে সাঙ্গু নদীতে আসা ঢলের পানিতে খাল-বিল ডুবে তলিয়ে গেছে পুকুর আর প্রজেক্ট। দীর্ঘ সময় বর্ষাকালীন বৃষ্টি না হলেও গত পাঁচদিনের হঠাৎ টানা বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মৎস্যজীবীদের। বৃষ্টি আর খালের পানিতে ডুবে গেছে পুকুর আর মাছের প্রজেক্ট। এতে ক্ষতি হয়েছে অসংখ্য মৎস্যজীবীর। তারা বলছেন হঠাৎ টানা বৃষ্টির কারণে তাদের পুকুর প্রজেক্ট ডুবে কোটি কোটি টাকার মাছ ও পোনা চলে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর মধ্যে আনোয়ারা সদরের বিলপুর, বোয়ালগাও, সিংহরা, বারখাইনের শিলাইগড়া, বারখাইন, তৈলারদ্বীপ, ঝিওরি, চাতরী ইউনিয়নের চাতরী, হাইলধর ইউনিয়নের হাইলধর, ইছাখালী, জুঁইদন্ডী ইউনিয়ন ও রায়পুর ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামের অধিকাংশ পুকুর ও মাছের প্রজেক্ট ডুবে গেছে বলে জানান ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষীরা। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জুঁইদন্ডী ও পরৈকোড়া এলাকার চাষীরা। এখানে অধিকাংশ পুকুর প্রজেক্ট ডুবে গেছে।
উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার রাশীদুল হক জানান,বৃষ্টি আর ঢলের পানির কারণে আনোয়ারায় অনেক মাছের পুকুর প্রজেক্ট ডুবে গেছে। এরমধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জুঁইদন্ডী এলাকায়। এছাড়াও চাতরী ও বারখাইন এলাকায় মৎস্যজীবিরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনোয়ারায় মৎস্যজীবীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকার।
ভেঙে গেছে গ্রামীণ সড়ক
ভারী বর্ষণ ও টানা পাঁচদিনের বৃষ্টিতে উপজেলার গ্রামীণ সড়ক ভেঙে বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। ফলে সড়কগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আনোয়ারায় প্লাবিত এলাকায় অন্তত ২০টি সড়ক ভেঙে গেছে। বিশেষ করে চাতরী ইউনিয়নের কৈখাইন – ডুমুরিয়া – রুদুরা বাংলাবাজার গ্রামীণ সড়কটি টানা বৃষ্টির ফলে রোববার ভোর রাতে বাংলা বাজারগামী ডুমুরিয়া ৮ ওয়ার্ড এলাকায় সড়কটি প্রায় ১০০ ফুট রাস্তা ৫ ফুট গভীরে দেবে যায়। এতে ওই সড়কে চলাচলকারী সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ হয়ে যাই। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ওই ৮ গ্রামের ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
উপজেলা প্রকৌশলী তাসলিমা জাহান বলেন, বন্যায় অন্তত ২০টির মত সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। তার মধ্যে কার্পেটিং সড়ক ৬টির মত হবে। আমরা যে গুলো আগে করা প্রয়োজন সে গুলো দ্রুত সংস্কার করব। বাকী গুলো ধাপে ধাপে সংস্কার করা হবে।
নষ্ট হয়েছে বেড়িবাঁধ সুইচগেইট
টানা বৃষ্টি আর প্রবল জোয়ারের পানিতে বেশ কিছু জায়গায় ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। নষ্ট হয়েছে বেশ কয়েকটি সুইচগেইট। জানা যায়, হাইলধর সাঙ্গু নদীর সুইচ গে ইট সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৮টি গ্রাম। গতকাল পানির স্রোত বন্ধে করতে স্থানীয়রা বালু দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করেন। আকবর নামের এক স্থানীয় জানান, এই এক পরিপূর্ণ সুইচগেইট বাঁধসহ নির্মাণ না করায় এই পূর্ব অঞ্চলের ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। গতকাল অবস্থা ভয়াবহ দেখে আমরা গ্রামবাসী বাঁধটি নির্মাণ করি। ছাড়াও কৈখাইনের সুইচগেইটসহ বেশ কয়েক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইশতিয়াক ইমন বলেন, এই বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। তাদের কর্মকর্তা এসে এটি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
আউশের চারা,আমনের বীজ তলার ব্যাপক ক্ষতি
আর এদিকে টানা বর্ষণ আর বন্যায় তলিয়ে গেছে আমনের বীজতলা। তলিয়ে গেছে আউশের ৪হাজার ৮৮ হেক্টর জমির চারা। আউশে বোরোর ক্ষতি পূরণের লক্ষ্য নিয়ে আউশ চাষ করা হলেও অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টির ফলে নষ্ট হয়ে গেছে বেশিরভাগ আউশের চারা। ফলে আউশের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষকেরা।
কৃৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী বলেন, টানা ভারী বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় আনোয়ারায় আউশের চারা এবং আমনের বীজতলা তলিয়ে গেছে। অনাবৃষ্টিতে অনেক চারা জ্বলে গেছিলো এবার অতিবৃষ্টিতেও আউশ চারার ব্যাপক ক্ষতি হবে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। তবে এটা কৃষকদের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হবে।
ত্রাণ বিতরণ
বন্যা কবলিত এলাকায় বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।