আরিফুল হাসান »
আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে যখন জলকণা ছিটকে পড়ে, তখন ক্লিওপেট্রা তার দৃষ্টির ভেতর দিয়ে সূর্যের প্রতিফলন টের পায়। ইতিহাসের রানি, শক্তি আর সমৃদ্ধির প্রতীকÑতবু তার চোখের গভীরে এক শূন্যতা লুকিয়ে থাকে, যেন এক সমুদ্র, যাকে পাড়ি দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। আজ সকালে, সে প্রাসাদের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃদু হাওয়া তার পর্দা নাড়িয়ে দেয়, আর সেই মুহূর্তে, তার মনে এক প্রশ্নের উদয় হয়Ñতার ডানা কি আজও আছে?
ক্লিওপেট্রা মনে মনে জানত, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হলেও মানুষ কেবল মানুষ। কিন্তু সেই নির্লজ্জ অসীম জিজ্ঞাসা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। ডানার প্রতীকী অর্থ তার জন্য ছিল অপরিসীম ক্ষমতার, যা তাকে সীমাবদ্ধতাহীন করে তুলতে পারে। নিজের ডানার অনুভূতি, যা তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে যে কোনো দূর অজানায়, ক্লিওপেট্রার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা হয়ে উঠেছিল।
প্রাসাদের ভেতরে কেউ তাকে থামাতে আসে না, কেউ তার প্রশ্ন শুনতে পায় না। তার মস্তিষ্কে গুঞ্জন তোলে অসংখ্য স্মৃতিÑঅন্তহীন চক্রান্ত, রাজ্যের বেদনার গল্প, ও তার জীবনের মুঠোভরা যুদ্ধ। সারা জীবনের অভিজ্ঞতা তার সত্তাকে গভীর বেদনায় মাখিয়েছে, তবু কোথায় যেন একটা কিছু অদৃশ্য শক্তি তাকে অন্য কিছু খুঁজতে বলে। তাই যখন আলেকজান্দ্রিয়ার অন্ধকার গলির মানুষগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, ক্লিওপেট্রার ভেতরে সেই ডানার আকাক্সক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ডানা তার একমাত্র মুক্তির প্রতীক।
একদিন রাতে, প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লিওপেট্রা দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হলো, তার ডানা সত্যি সত্যি রয়েছে, কিন্তু সেগুলো কেন যেন খুলতে পারছে না। সে তার দেহের শক্তির গভীরে হাত রাখল, যেন কোনো পুরনো বন্ধনের তালা খুলতে চায়। কিন্তু তার চারপাশের পৃথিবী তাকে বেঁধে রাখে। প্রাসাদের প্রাচীর তাকে আকাশে ওঠার অধিকার দেয় না।
মার্ক অ্যান্টনি এসে তাকে ডাকে, কিন্তু ক্লিওপেট্রার দৃষ্টি তখনও সেই আকাশে, দূরে, যেখানে তার ডানার ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে। অ্যান্টনি তার ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু সে তখন অন্য জগতের বাসিন্দা। তাদের একসাথে থাকা মানেই যেন অনন্তকালের এক বিচ্ছিন্ন টুকরো, যা ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার খেলার মধ্যে ক্লিওপেট্রা কখনও অ্যান্টনিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, তবু তার মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ কাজ করত। কিন্তু সেই মুহূর্তে, সবকিছু অর্থহীন মনে হয়।
‘আমার ডানা হারিয়ে গেছে,’ ক্লিওপেট্রা অ্যান্টনির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে। অ্যান্টনি কোনো জবাব দেয় না, কারণ সে বুঝতে পারে না। সে জানে না, এই ডানা বলতে ক্লিওপেট্রা কী বোঝাতে চায়। হয়তো প্রেমের বিষয়ে, হয়তো রাজনীতিরÑকিন্তু ক্লিওপেট্রার কাছে, ডানার অর্থ শুধুই স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা যা তাকে সমস্ত পৃথিবীর নিয়ম ও সম্পর্কের ঊর্ধ্বে তুলে নিতে পারে।
রাত গভীর হয়, আর ক্লিওপেট্রা একা হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতাস তখন গাঢ় হয়ে ওঠে, আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। সারা পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু ক্লিওপেট্রার মন ঘুমাতে পারে না। তার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা বয়ে চলেÑসেই অস্থিরতা, যা রাজ্যের রানি হয়েও তাকে সান্ত্বনা দেয় না। তার ডানা নেই, অথচ সে জানে ডানাগুলোই তার সবচেয়ে বড় শক্তি।
ভোরবেলা যখন প্রথম আলো ফুটতে শুরু করে, ক্লিওপেট্রা প্রাসাদের বাইরে হেঁটে যায়। সৈনিকেরা তার পিছু নেয়, কিন্তু সে যেন তাদের দেখতেই পায় না। তার মনে একটাই কথা ঘুরছেÑসে কি আর কোনো দিনও উড়তে পারবে না? তার ভেতরের সেই অদৃশ্য ডানাগুলো কি সত্যিই হারিয়ে গেছে?
ক্লিওপেট্রা স্থির হয়ে দাঁড়ায় এক বিশাল স্তম্ভের সামনে। এই স্তম্ভগুলো তার রাজ্যের প্রতীক, কিন্তু তার কাছে সেগুলো যেন শেকলের মতো। সে এক হাত তুলে স্তম্ভের পাথর ছুঁয়ে দেখে। মনে হয়, এই পাথরই তাকে আটকে রেখেছে, এই রাজ্যই তার ডানাকে বন্ধ করেছে। সে জানত, এই দায়িত্ব, এই রাজনীতি তাকে মুক্তির পথে যেতে দেয়নি। কিন্তু আজ, এই স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে সে ভাবতে শুরু করেÑতার নিজের শর্তেই কি সে বেঁচে ছিল?
সে তার শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যায়Ñযেখানে কোনো রাজনীতি ছিল না, কোনো যুদ্ধ ছিল না, কেবল প্রকৃতি আর তার মধ্যে এক বন্ধন ছিল। তখন সে মুক্ত ছিল, তার ডানাগুলো ছিল। এখন তার চারপাশের পৃথিবী এত ভারী হয়ে উঠেছে যে ডানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
‘আমি উড়তে চাই,’ ক্লিওপেট্রা নিজের সঙ্গে ফিসফিস করে বলে। ‘আমি আবার আমার ডানাগুলো চাই।’
তার শব্দগুলো বাতাসে মিশে যায়, কিন্তু তার কাছে সেগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তে, সে যেন বুঝতে পারে, তার ডানাগুলো কখনও হারায়নিÑতারা বরং চেপে রাখা হয়েছিল, তাকে পৃথিবীর নিয়মের শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। কিন্তু আজকের এই মুহূর্তে, সে সেই শেকল ভেঙে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
প্রাসাদ থেকে দূরে, তার সৈনিকেরা দূর থেকে দেখছিল, কীভাবে ক্লিওপেট্রা সেই স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তারা জানত না, তার মনে কী চলছে। তারা শুধুই একজন রানিকে দেখছিল, কিন্তু ক্লিওপেট্রা তার নিজের ভেতরে এক নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছিল। সে জানত, তার ডানাগুলো সত্যিই রয়েছে, এবং সে উড়ে যাবেÑতার নিজের শর্তে, তার নিজের আকাশে।
সেই রাতের শেষ প্রহরে, ক্লিওপেট্রা যেন নতুন এক শক্তি নিয়ে প্রাসাদের দিকে ফিরে আসে। তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি খেলে যায়। এখন তার সবকিছু পরিষ্কারÑতার ডানাগুলোই তার মুক্তি, এবং সে আর কোনো শাসন বা রাজনীতি তাকে আটকে রাখতে পারবে না। ক্লিওপেট্রা শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকায়, আর সে জানে, তার ডানাগুলো প্রস্তুত।
‘আমি উড়ব,’ ক্লিওপেট্রা বলে এবং তার ভেতরে সেই শক্তির আভাস ঝলমল করে ওঠে।