শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »
দেশের রপ্তানি শিল্পের অন্যতম প্রধান খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্প। প্রতিবছর এ খাত থেকে আয় হয় সিংহভাগ রাজস্ব। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে এ শিল্প। পুরানো ক্রয়াদেশ কার্যকর করায় গতবছরের তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়লেও কমেছে আগামীর সম্ভাবনা। সক্ষমতার তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম ক্রয়াদেশের কারণে ‘উদ্বিগ্ন’ তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি হয়েছে ৪২ হাজার ৬১৩ দশমিক ১৫ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮১.৮১ ভাগ। সে ধারাবাহিকতায় এ খাতের বর্তমান অর্থবছরের (২০২২-২০২৩) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৬ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৩৮ হাজার ৫৭৭ দশমিক ৫১ মার্কিন ডলার, যা এই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চারশত মার্কিন ডলার বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানির ধারাবাহিকতা দিন দিন কমছে।
তৈরি পোশাক খাতের নিট ও ওভেনে রপ্তানি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) জানায়, রপ্তানি বৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৬ দশমিক ৬১, আগস্টে ৩৬ দশমিক ০৪, অক্টোবরে ৩ দশমিক ২৭, নভেম্বরে ৩৫ দশমিক ৩৬, ডিসেম্বরে ১৫ দশমিক ৩৫, জানুয়ারিতে ৮ দশমিক ২৪, ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এরমধ্যে সেপ্টেম্বরে ও মার্চে রপ্তানির হার কমে গেছে। সেপ্টেম্বরে কমেছে ৭ দশমিক ৫২ এবং মার্চে কমেছে ১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এপ্রিলের প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত করা না হলেও খসড়া প্রতিবেদনে রপ্তানি হার কমেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-এর সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. নাজমুল বলেন, ‘দীর্ঘসময় নিয়ে দেশের রপ্তানি খাতকে লাভজনক করে তৈরি পোশাক শিল্প খাত গড়ে ওঠে। বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থান অর্জন করে। ফলে আরও ভালো করার লক্ষ্য নিয়ে পোশাক শিল্প মালিকরা কাজ করছেন। তারা বর্তমানে ৫০ বিলিয়ন ডলার পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করতে প্রস্তুত রয়েছেন। সে অনুযায়ী তাদের ক্রয়াদেশ আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে আমরা এক্সপোর্ট গ্রোথ রেট (রপ্তানি বৃদ্ধির হার) নির্ধারণ করেছি ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। কিন্তু মার্চ থেকে এ গ্রোথ রেট মাইনাসে চলে গেছে।’
রপ্তানি কমে যাওয়া নিয়ে কথা হলে এফ এইচ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বিজিএমইএ-এর হিসেবে চট্টগ্রামে ৭৬টি কারখানা তাদের তালিকাভুক্ত। এর বাইরেও উৎপাদনে সচল রয়েছে আরও ১৮০টি কারখানা। অনেকে আবার সাব-অর্ডার নিয়েও কাজ করে। সবমিলিয়ে ৪৫০টির মতো কারখানা সচল রয়েছে। কিন্তু গত ছয়-সাত মাসে এসব কারখানায় ৪০ ভাগ কার্যাদেশ কমে গেছে। কিন্তু খরচ কোনো দিকেই কমেনি। সবদিকে খরচ বেড়েছে। অনেকেই বলছেন ডলারের দাম বাড়ায় আমরা লাভবান হয়েছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের কুরিয়ার চার্জ দ্বিগুণ হয়েছে। কাঁচামালের দামও বেড়েছে। অর্ডারও ইদানিং কমে এসেছে। যা অল্প অর্ডার আসছে তার রেটও (দর) কম। সব খরচ মিলিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরমধ্যে ব্যবসার অবস্থাও এমন যে, ব্যাংক ঋণ বাড়াতেও ভয় লাগছে।’
ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী সরাসরি মূল বায়ার বা স্টোরে যোগাযোগ করে ব্যবসা করেন। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ীকে ব্যবসা করতে হয় ইম্পোর্টারদের অধীনে। বায়াররা সম্প্রতি ক্রয়াদেশের কমিয়ে দিয়েছেন। আমরাও কম রেটে অর্ডার নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ইম্পোর্টাররা তাদের লাভ ছাড়তে রাজি নয়। সেই কারণেও অর্ডার অনেক পরিমাণে কমেছে।’
ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক খন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দায় অর্ডার কম। আর যে অর্ডার আসছে তার দরও কম। কিন্তু ব্যবসায়ীরাতো তাদের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) বাড়িয়েছে। ফলে তাদের ব্যয়ও বেড়েছে। এরমধ্যে মন্দা অবস্থায় শ্রমিকদের একটা ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ব্যবসায়ে সম্ভাবনার কথা ভেবে খরচ করতে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন পিছু হটারও কোনো সুযোগ নেই।’
তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি সুপ্রভাতকে বলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের ব্যবসায়ের স্ট্র্যাটেজি মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাঁচামালসহ সবদিকে দাম বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কারণে ব্যয়ও বেড়েছে। আমরা এখন ৫০ বিলিয়ন ডলার ক্রয়াদেশ নিতে প্রস্তুত। সে অনুপাতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমেছে। এ বছরে নতুন করে কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।’