পর্যাপ্ত আমদানি, সংকট থাকার কথা নয়: কাস্টমস
রাজিব শর্মা »
গত তিন থেকে চার মাস আগে আমদানি করা হলেও টাকার বিপরীতে বর্তমানে ডলারের দর বেড়ে যাওয়া, আমদানি সংকটের পাশাপাশি নানা অজুহাতে কোরবানির এক মাস আগেই অস্থির হয়ে ওঠেছে মসলার বাজার। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জিরা, এলাচ ও লবঙ্গের মতো মসলার দাম কেজিপ্রতিতে বেড়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি মসলা বিক্রেতা ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শতভাগ মার্জিন ও ব্যাংকে এলসি জঠিলতা, অতিরিক্ত শুল্ক হারের কারনে অনান্য বছরের তুলনায় এবছর ভারত, গুয়েতমালা, সিরিয়া, মিশর, পাকিস্থানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মসলা আমদানি কম করা হয়েছে। যার কারনে যত ঈদ ঘনিয়ে আসছে ততই মসলার চাহিদা বেড়ে যাওয়াতেই এলাচ, জিরা, লবঙ্গ, মৌরি, দারুচিনি, গোলমরিচসহ নানা মসলার উপকরণের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ঈদের আগে আরও দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা যায়।
তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি কম হওয়ার অজুহাতে গত তিনমাস ধরেই দেশের বাজারে এলাচের দাম লাগামহীন। এমনকি প্রশাসনের টানা কয়েকটা অভিযানেও মসলাজাত এ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। এ ছাড়া গতবছর জুলাই ও ডিসেম্বরে ভারত ও গুয়েতমালা থেকে যেসব এলাচি ১ হাজার ৭০০ টাকায় আমদানি করেছে তা এখন খাতুনগঞ্জের আড়তে ৩ হাজার ৬০০ থেকে ৪ হাজার পর্যন্ত বিক্রি করতে দেখা যায়। এবং যে ভারতীয় জিরা জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ৩৫০ থেকে ৩৬৫ টাকায় আমদানি করা হয় তা দ্বিগুন দাম বাড়িয়ে পাইকারি বাজারে এখন বিক্রি করা হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া জানুয়ারিতে আমদানি করা লবঙ্গে ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬২০ টাকা। শুধু এলাচ, জিরা ও লবঙ্গ নয়, অজুহাতের ওপর ভর করে লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ, মৌরি এবং জয়ত্রির দাম ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দিয়েছেন খাতুনগঞ্জের আড়তদারেরা। বিশেষ করে পবিত্র ঈদুল আজহার দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে, ততোই অস্থির হয়ে উঠছে অতি প্রয়োজনীয় মসলার বাজার।
বকসিরহাটের খুচরা ব্যবসায়ী রহমানিয়া পাশারি দোকানের মালিক নেওয়াজ সিকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের আগে প্রশাসনের নজরদারি বেড়ে গেলে মসলার বাজারে চড়া দরে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখা অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনী জঠিলতায় পড়তে হয়, তাই দেড় থেকে দুই মাস আগে কৌশলে মসলার দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। যেন প্রশাসন বিষয়টি বুঝতে না পারেন।
সোমবার দেশের বৃহত্তর ভোগ্যপন্যের বাজার খাতুনগঞ্জের মসলার আড়ত ঘুরে দেখা যায়, গত দুই মাসের ব্যবধানে বর্তমানে প্রতি কেজি প্রতি কেজি জয়ত্রীতে ৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৯০০ টাকা, কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে দারুচিনি ৫০০ টাকা, জায়ফল ৩০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকা, তেজপাতা ১০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা, কালোজিরায় ৩০ টাকা বেড়ে ২৯০ টাকা, কেজিতে ৮০ টাকা বেড়ে ভারতীয় হলুদ ২৯০ টাকা, আমদানি ও দেশী শুকনা লাল মরিচে ১০০ টাকা বেড়ে ৩৮০ থেকে ৪৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সাদা সরিষা ২৬৫ টাকা, ধনিয়া ১৬০ টাকা ও গোলমরিচ ৮২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের মের্সাস বি আর এম এন্টারপ্রাইজের মালিক জামাল হায়দার বলেন, অনান্য বছরের তুলনায় এবছর মসলার উপকরনের আমদানি কম হয়েছে। যার কারনে সকল ধরনের মসলার বাজারে ৩০ থেকে ১০০ টাকা দাম বেড়েছে।
আল রহমানিয়া ট্রেডিং এর ফরহাদ মজুমদার বলেন, মসলার বাজারে ৫০ থেকে ১০০ টাকা উঠানামা করে। সারাবছর সামাজিক অনুষ্টানের পাশাপাশি ঈদকে ঘিরে মসলার চাহিদা বেড়ে যায়। তার মধ্যে চাহিদা অনুযায়ে আমদানিতে যোগান সংকট রয়েছে। যার ফলে মসলার বাজার অস্থির হয়ে উঠে।
বাংলাদেশ মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, জিরা ও এলাচের বাজার ভারতের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। ভারতের বাজারেই এসব পণ্যের সংকট চলছে। তার প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারে। আর গুয়েতমালা, মিসর ও সিরিয়া থেকে যেসব মসলা আমদানি করতে হচ্ছে তার আমদানি খরচও বাড়তি দিতে হচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা মসলার আমদানিতে জঠিলতা, বিশ^ বাজারে সংকটে চাহিদা অনুযায়ে দেশীয় বাজারে যোগান সংকট রয়েছে জানালেও বিপরীতে অতিরিক্ত আমদানি হওয়ায় এ মুহূর্তে বাজারে মসলার কোনো সংকট নেই বলে দাবি করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২৪ হাজার ২৬৭ মেট্রিক টন এলাচ, ৪১ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন জিরা, ৩২ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন লবঙ্গ এবং ২৯ হাজার ৬৪৬ মেট্রিক টন গোল মরিচ আমদানি হয়েছে। তথ্যমতে এটি গত বছরের তুলনায় চলতি বছর আমদানির পরিমান অনেক বেশি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাজিউর রহমান মিয়া জানান, মসলার বাজারে যেন কোন ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না হয় তার জন্য যত দ্রুত সম্ভব পণ্য খালাস করা হচ্ছে। এবং এবছর আমদানিতে মসলার বাজারে সংকট থাকার কথা নয়।
উল্লেখ্য, গত ৮ মে প্রতি ডলারের দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ১১০ টাকা। এ ইস্যুকে সামনে এনে গত বছরের মাঝামাঝি ও চলতি বছরের শুরুতে আমদানি করা মসলা অস্থির বাজারকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা।