ফজলে এলাহী, রাঙামাটি
ছবি দেখেই যে কেউই বলে দিতে পারেন এটির অবস্থান,তাই ৩৫ বছর বয়সী ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ছোট্ট সেতুটিই যেনো ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’! অথচ ফি বছর নিয়ম করেই একটা সময় পানিতে ডুবে থাকছে এ সেতু। বন্ধ থাকে দর্শনার্থী প্রবেশ, ফলে শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা যেমন বঞ্চিত হন কাক্সিক্ষত সেতুটি দেখতে, তেমনি শহরবাসীরও মন খারাপ হয়। কিন্তু নানান আশ^াস আর চেষ্টাতেও মিলছে না ‘পানিতে ডুবে থাকা’র এই স্থায়ী সমস্যার ! এ বছর ৩ সেপ্টেম্বর ডুবে গেছে ঝুলন্ত সেতুটি; যা এখনো পানির নীচে। ফলে বন্ধ পর্যটন কমপ্লেক্স’র টিকেট বিক্রি। কবে কমবে পানি,জানেনা কেউই।
কেনো বারবার ডুবে সেতু ?
রাঙামাটি শহরের একদম শেষ প্রান্তে অবস্থিত পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স। এর ভেতরেই দুটো পাহাড়কে সংযুক্ত করে ১৯৮৫ সালে নির্মিত হয় ‘কেবল স্টে ব্রিজ’টি। প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এই সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে মোটা কেবল এবং দুপ্রান্তের চারটি পিলারের উপর। কিন্তু সেই সময় হ্রদের পানির উচ্চতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি সেতুটি স্থাপনের উচ্চতা নির্ধারণেই সমস্যা করে। ফলে নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধনের দুইবছর পরই ১৯৮৭ সালে সেতুটি পানির নীচে ডুবে যায় বর্ষা মৌসুমে। সেই থেকে প্রায় নিয়ম করেই,যে বছরই ভারি বৃষ্টিপাত হয়,সে বছরেই পানির নীচে ডুবে যায় অত্যন্ত দর্শনীয় এই সেতুটি। আবার কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পানি সংরক্ষণ করে রাখার জন্যও যখন হ্রদের স্লুইচগেট গুলো বন্ধ রাখা হয়,তখনো বাড়তি পানির চাপে ডুবে যায় সেতু।
সেতুর কাঠের পাটাতন পানির নীচে ডুবে গেলেই নোটিশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় সেতুতে চলাচল। অথচ রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অনিবার্য গন্তব্যই হলো এই সেতু।
পর্যটনের বিপুল ক্ষতি
রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটক কিংবা শহরবাসী,সবারই প্রিয় গন্তব্য ঝুলন্ত সেতুর স্থান পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স। কারণ এই ওইপাড় থেকে ইঞ্জিনচালিত বোটে করে যেতে হয় সুভলং ঝর্ণা কিংবা হ্রদবর্তী অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে। ফলে এই ঝুলন্ত সেতুতে প্রবেশের ঠিক আগেই কাটতে হয় টিকেট। কিন্তু সেতু ডুবে গেলেই বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক প্রবেশ ও টিকেট বিক্রি। যতদিন পানি না কমে সেতুটি সংস্কার করা সম্ভব হয়না,ততদিন বন্ধ থাকে টিকেট বেচাকেনা। দিনে ন্যূনতম ১০/১৫ হাজার থেকে লক্ষ টাকারও বেশি টিকেট বিক্রির আয় থেকে বঞ্চিত হয় পর্যটন। শুধু তাই নয়, সেতু ডুবে গেলে পর্যটকরা আর থাকতে চাননা পর্যটন মোটেলেও। ফলে সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন বিভাগ।
কি ভাবছে পর্যটন বিভাগ
বহুবছর ধরেই বলা হয়ে আসছে, সেতুটি সংস্কার করা হবে। কিছুটা উপরে তোলা হবে। কিন্তু কারিগরি নানা দিক বিবেচনায় বিষয়টি প্রায় অসম্ভব হওয়ায় স্থানীয়ভাবে বারবার প্রস্তাব পাঠানো হলেও এবং বারবার ঢাকা থেকে প্রকৌশলীরা এসে দেখে গেলেও মিলছে না কাক্সিক্ষত সমাধান।
রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন এর ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলছেন-‘সেতুটি দেখতেই আসে অসংখ্য মানুষ,যখন সেতু ডুবে থাকে,তখন বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও অবহিত আছেন। ইতোমধ্যই সেতু ডুবে যাওয়ার বিষয়টি আমি জানিয়েছি।’
‘সেতুটি সংস্কার করে খুব একটা লাভ হবেনা’ মন্তব্য করে রাঙামাটি পর্যটনের সাবেক ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া বলেন, ‘নির্মাণশৈলির কারণেই সেতুটি সংস্কার করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল। আমি মনে করি এটিকে বাদ দিয়ে নতুন আরেকটি সেতু করা যেতে পারে আরো নান্দনিকভাবে। অনেকটা কলকাতার হাওড়া ব্রিজের মতো করে,তাতে দর্শনার্থীদেরও আগ্রহ বাড়বে, বৈচিত্র্যও আসবে।’
প্রকৌশলী ও প্রশাসনের ভাষ্য
পর্যটন ব্যবস্থাপকের কথারই ইঙ্গিত মিলল পার্বত্য জেলায় পর্যটনের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়ুয়ার কন্ঠে।
বিরল বড়ুয়া বলেন, ‘এই সেতুটি নির্মাণ ব্যয় খুব একটা বেশি ছিলোনা, এটি সংস্কার করা প্রায় অসম্ভব। কারণ এটিকে তুলতে গেলে বর্তমান কেবল এবং পিলার তার লোড নিবেনা। তারচে এটির পাশাপাশি আরেকটি সেতু নির্মাণের কথা ভাবছি আমরা। আরো সুন্দর ডিজাইনে এবং বড় পরিসরে সেটা করতে চাই আমরা। এই বিষয়ে একটি কারিগরি কমিটিও হয়েছে। আমি বিষয়টি দেখভাল শুরু করব। দেখা যাক কি করা যায়।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর নির্বাহী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা বলছেন-‘এই সেতুটি রাঙামাটির ঐতিহ্যের একটি অংশ। এটি না ভেঙ্গে সংস্কার করার পাশাপাশি এর পাশেই যদি আরেকটা সেতু করা যায় খুব ভালো হবে। কারণ পলি জমার কারণে কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, ফলে পানি বাড়লেই সেতুটি ডুবে যাচ্ছে। এই কারণে নতুন সেতু কিংবা সংস্কারের পর এই সেতুটি আরো উঁচুতে করতে হবে।’
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন খান বলছেন,‘সেতু ডুবে যাওয়ার বিষয়টি আমি জেনেছি। পূর্বের জেলা প্রশাসক এই বিষয়ে ট্যুরিজম বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছিলেন। আমি তাহলে বিষয়টি একটু খোঁজ নিয়ে দেখি,যদি এমন কোন পত্র দেয়া হয়ে থাকে,তবে আমি তাগাদাপত্র দিব।’