বিচিত্র কুমার »
হেমন্তের এক ভোরে পুরো হেমন্তপুর যেন সাদা চাদরে মোড়ানো। মাঠ, গাছ, নদীর তীর- সব জায়গায় কুয়াশার নরম পর্দা ঝুলে আছে। ঠান্ডা হাওয়ায় শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গ্রামের শিশুরা কম্বলে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে, কিন্তু পাখিদের মধ্যে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। আজ নাকি হবে “কুয়াশার রাজমুকুট” প্রতিযোগিতা!
এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ধনেশপাখি রাজা নিজে। প্রতি বছর হেমন্তের প্রথম পূর্ণিমা রাতে যে পাখির মাথায় সবচেয়ে সুন্দর কুয়াশার মুকুট থাকবে, তাকেই ঘোষণা করা হয় “হেমন্তপুরের রাজপাখি”!
চড়ুই, শালিক, বুলবুলি, ফিঙে-সবাই আজ ভোর থেকেই নিজের নিজের পালক পরিষ্কার করছে। কেউ কুয়াশা ছোঁয়া শিশির দিয়ে পালক ঝলমল করছে, কেউ আবার মাটির ধুলো মুছে চকচকে করছে। ছোট্ট পাখিটা, নাম তার টুনটুনি, তাকিয়ে দেখছে সবাই কেমন সাজছে। কিন্তু সে দুঃখে হাঁপ ছেড়ে বলে, “আমার তো রাজমুকুট বানানোর মতো কিছুই নেই!”
তখনই পাশের গাছের ডালে বসে থাকা পুরনো ফড়িং দাদু হেসে বললেন, “তুই চাইলে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি টুনটুনি। কুয়াশার রাজমুকুট বানাতে চাইলে তোকে খুঁজে আনতে হবে তিনটা জিনিস ভোরের প্রথম রোদের সোনালি রেশ, শিশিরবিন্দুর ঝিলিক, আর সাদা মেঘের একটুখানি ঘ্রাণ।”
টুনটুনি তো অবাক! সে ছোট্ট পাখি, এতসব কেমন করে আনবে? কিন্তু সে হাল ছাড়ল না।
প্রথমে সে উড়ে গেল নদীর ধারে। সূর্যের প্রথম কিরণ যখন কুয়াশার ফাঁক গলে বেরিয়ে এল, টুনটুনি তার ডানায় সেই রোদের আলো একটু ছুঁয়ে নিলো। মনে হলো, যেন সোনালি ঝলক ডানায় লেগে রইল।
এরপর সে গেল মাঠে। শিশিরবিন্দুতে ভরা কাশফুলের গায়ে হালকা ঠান্ডা ঝলক। টুনটুনি নরম ঠোঁটে ছুঁয়ে নিল কয়েকটা শিশিরবিন্দু। তারা যেন হাসতে হাসতে বলল, “আমরা তোমার মুকুটে আলো দেবো!”
সবশেষে সে উড়ে গেল আকাশের দিকে। মেঘেরা তখন ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছে। টুনটুনি ডানায় একটুখানি সাদা মেঘের ছোঁয়া নিল। মেঘটা যেন বলল, “আমি তোমার মুকুটে কোমলতা আনবো।”
এই তিন রত্ন নিয়ে টুনটুনি ফিরে এলো ফড়িং দাদুর কাছে। দাদু কুয়াশার সুতোর মতো নরম বাষ্প দিয়ে সোনালি রোদ, শিশির আর মেঘকে একসাথে বেঁধে দিলেন। মুহূর্তেই তৈরি হলো এক অপূর্ব রাজমুকুট সাদা, সোনালি, ঝলমলে!
রাত নামলেই ধনেশপাখি রাজা সব প্রতিযোগীকে ডাকলেন। সবাই নিজের তৈরি মুকুট পরে হাজির হলো। কেউ ফুল দিয়ে সাজিয়েছে, কেউ পালক, কেউ রুপালি ঘাসের গুচ্ছ। কিন্তু যখন টুনটুনি এল তার কুয়াশার রাজমুকুট পরে, সবাই হতবাক!
মুকুটটা আলো ছড়াচ্ছে, তবুও হালকা, কুয়াশার মতো স্বচ্ছ। চাঁদের আলোতে সেটা ঝলমল করছে যেন আকাশের কোনো তারা নেমে এসেছে তার মাথায়।
রাজা ধনেশপাখি গম্ভীর গলায় বললেন, “আজ থেকে টুনটুনি হবে হেমন্তপুরের রাজপাখি! কারণ তার মুকুটে শুধু সৌন্দর্য নয়, আছে পরিশ্রম, সাহস আর মনের বিশুদ্ধতা।”
সেদিন থেকে হেমন্তপুরে যখনই কুয়াশা নামে, সবাই বলে-
“দেখো, টুনটুনির রাজমুকুট ঝলমল করছে!”
আর সেই কুয়াশা তখন সত্যিই মনে হয়
হেমন্তের সাদা মুকুট, টুনটুনির রাজমুকুট।





















































