পাকিস্তান থেকে জাহাজে করে যা আনা হলো

বাংলাদেশ-পাকিস্তান সরাসরি সমুদ্র যোগাযোগ

গত সোমবার (১১ নভেম্বর) পাকিস্তানের করাচি থেকে পানামার পতাকাবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে  আসে। ছবি: সংগৃহীত

ডেস্ক রিপোর্ট »

প্রথমবারের মতো সরাসরি সমুদ্র যোগাযোগ স্থাপন করলো বাংলাদেশ-পাকিস্তান। গত সোমবার (১১ নভেম্বর) পাকিস্তানের করাচি থেকে পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে  প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালের  মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম করাচি থেকে একটি পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পানামার পতাকাবাহী (YUAN XIANG FA ZHAN) নামের কনটেইনার জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে সোমবার (১১ নভেম্বর)। এতে ৩৭০ একক কনটেইনার পণ্য ছিল। পরদিন জাহাজটি পণ্য খালাস করে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে বন্দর ছেড়ে যায়।

প্রথমবারের মতো নতুন এ পরিবহনসেবায় পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে সরাসরি কনটেইনারে করে পণ্য আনা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর আগে পাকিস্তানের কনটেইনার পণ্য তৃতীয় দেশ হয়ে চট্টগ্রামে আনা হতো।

দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ জাহাজে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য এসেছে।

এসব পণ্যের মোট ওজন ছয় হাজার ৩৩৭ টন। পাকিস্তানের ১৮টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এ পণ্যগুলো সরবরাহ করেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরসচিব ওমর ফারুক জানান, জাহাজটি কনটেইনারগুলো নামিয়ে মঙ্গলবার বন্দর ত্যাগ করেছে। আমদানিকারকদের এখন এসব পণ্য খালাসের জন্য কাস্টমস প্রক্রিয়া শুরু করার কথা।

বন্দর ও কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, জাহাজে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। মোট ১১৫ কনটেইনারে সোডা অ্যাশ আনা হয়েছে।

এছাড়া ৪৬ একক [ইউনিট] কনটেইনারে ডলোমাইট এবং ৩৫ একক কনটেইনারে চুনাপাথর আনা হয়েছে। ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট এসেছে ছয় কনটেইনারে। আর কাচশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভাঙা কাচ আনা হয়েছে ১০ কনটেইনারে।

শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কাঁচামাল যেমন কাপড়, রং ইত্যাদি রয়েছে ২৮টি কনটেইনারে। এছাড়াও, একটি কনটেইনারে রয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ।

এসব পণ্য আমদানি করেছে আকিজ গ্লাস কারখানা, নাসির ফ্লোট গ্লাস, প্যাসিফিক জিনস, এক্স সিরামিকস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

প্রথমবারের মতো নতুন এ পরিবহনসেবায় পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে সরাসরি কনটেইনারে করে পণ্য আনা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর আগে পাকিস্তানের কনটেইনার পণ্য তৃতীয় দেশ হয়ে চট্টগ্রামে আনা হতো।

এ নতুন সেবায় প্রথমবার পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে কী পণ্য আনা হয়েছে, তা নিয়ে দেশে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করার আগে জাহাজটি থেকে ৩৭০ একক কনটেইনার নামানো হয়। এর মধ্যে ২৯৭ একক কনটেইনার এসেছে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে এবং ৭৩ একক কনটেইনার এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।

বুধবার (১৩ নভেম্বর) ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, করাচি থেকে সারাসরি পণ্যবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে, যা দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ।

এতে আরও বলা হয়েছে, এই সরাসরি রুটটি সরবরাহ শৃঙ্খলা আরও সহজ করবে এবং পণ্য পরিবহনে সময় কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ২ হাজার ৩০০টি (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) ধারণক্ষমতার এই জাহাজটি বিভিন্ন ধরনের পণ্য বহন করে এনেছে। যা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিফলন।

বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ সরাসরি শিপিং রুটকে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি এই অঞ্চলে আরও সমন্বিত ও বাণিজ্য নেটওয়ার্ক জোরদারে একটি বড় পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, এই উদ্যোগটি কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যের গতি বাড়াবে না, বরং ছোট ব্যবসায়ী থেকে বড় রফতানিকারক পর্যন্ত উভয় পক্ষের ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। সম্প্রতি ভারত ঘেঁষা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এই উষ্ণতার সূচনা হয়েছে।

দেশের শীর্ষ স্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা ও  প্রিমিয়ার সিমেন্ট পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে নিয়মিত রুট নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভিন্ন চ্যানেলে না এনে চাল, পেঁয়াজ, ফলমূলসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, এমনকি পোশাকের কাঁচামাল সরাসরি আনা গেলে আর্থিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। আবার পাটসহ অনেক পণ্যের রফতানিও ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো ধরনের সংকীর্ণতা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়ার পথকেও সংকীর্ণ করে তোলে।

বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান।

এদিকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে জাহাজ আসার ঘটনায় গভীর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে (সেভেন সিস্টার্স) সম্ভাব্য অস্থিরতা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে এই রাজ্যগুলো অবস্থিত।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পর ইসলামাবাদ ও ঢাকা উভয়ই সম্পর্কে উষ্ণতা আনা এবং স্বাভাবিকীকরণে আগ্রহ প্রকাশ করে। গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে সাক্ষাৎ করেন। যেখানে তারা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটে।