শান্তা মারিয়া »
রাজধানীর কলাবাগানে স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার ফারদিন ইফতেখার দিহান ও তার সঙ্গীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে শনিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি-২৭ নম্বরে বিক্ষোভ করেন মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীরা।
প্রথমে ভেবেছিলাম কিছু লিখব না। কি হবে লিখে? কিন্তু স্নায়ুর ওপর ঘটনাটি এত বেশি চাপ সৃষ্টি করছে যে প্রতিবাদ না করে পারছি না। কলাবাগানে ও লেভেলের ছাত্রী হত্যার ঘটনায় কেবলি মনে হচ্ছে এ কোন অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? এখানে কিশোর গ্যাং, ধর্ষক ও নিপীড়করা যে কোন মুহূর্তে তাদের ধারালো নখ দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নারীর ওপর। হোক সে নারী তার বন্ধু, প্রেমিকা, বন্ধুর বোন কিংবা বোনের বান্ধবী। কিভাবে জন্ম হয় একজন দিহানের? কিভাবে এই বয়সের একটি তরুণ পাশবিক রিরংসায় হত্যা করে তার বন্ধু বলে সরল বিশ্বাসে এগিয়ে আসা সহপাঠীকে? পাড়ায় মহল্লায় কেন গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং? কেন কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন, ধর্ষণ, হত্যার শিকার হচ্ছে কিশোরী, তরুণী এমনকি তাদের মায়ের বয়সী নারীরাও?
দিহানের কথাই ধরা যাক। একজন তরুণ একদিনে কিন্তু পাশবিকতায় উন্মত্ত ধর্ষক হয়ে ওঠে না, খুনি হয়ে ওঠে না। দীর্ঘদিন ধরে সে নারীর প্রতি যে চিন্তা চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে সেই চিন্তারই প্রতিফলন ঘটে তার আচরণে। দিহানের সম্পর্কে গণমাধ্যমসূত্রে যেটুকু জানা গেছে তা হলো সে ছিল বখাটে প্রকৃতির তরুণ। সে নিত্যনতুন গাড়ি হাঁকাত, বাইক চালাত, বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। অপ্রাপ্ত বয়স থেকেই সে গাড়ি হাঁকায়। সেসব ছবি সে সোশ্যাল মিডিয়াতে দিয়ে বাহবা কুড়ায়। কিশোর ছেলে যখন গাড়ি চালায় তখন তার বাবা, মা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়? কেন তারা বাধা দেয়নি? বাঁধা দেয়নি কারণ তারা মনে করে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো কোন অপরাধ নয়। তারা তাকে প্রশ্রয় দেয় নিশ্চিতভাবেই।
আরেকটি প্রশ্ন হলো এত টাকা সে পেত কোথায়? এখানেই আসে পরিবারের ভূমিকার কথা। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার। বুঝতে বাকি থাকে না জলের মতো আসা টাকা বৈধ না অবৈধ। গণমাধ্যমের সূত্রে আরও জানা গেছে দিহানের বড় ভাইয়ের নামেও স্ত্রীকে বিষপ্রয়োগে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। পরিবারটি নাকি এত ক্ষমতাশালী ও অর্থের মালিক যে এলাকায় তারা প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে সব অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে রাখার ক্ষমতা ধরে। এই পরিবারের তরুণ ধর্ষণ ও হত্যা করবে না তো কে করবে?
এই ধরনের পরিবারে বেড়ে ওঠা তরুণরা জানে তারা যত অপরাধই করুক পরিবার তাদের সব অপরাধ চাপা দিয়ে তাদের সাজাভোগ থেকে খালাস করে আনবে এবং উল্টো চড়াও হবে ভিকটিমের পরিবারের ওপর। এজন্যই তারা সাহস পায় এবং অবলীলায় অপরাধ ঘটায়।
কিশোর গ্যাংয়ের দিকে তাকানো যাক। একদল মূল্যবোধহীন কিশোর তরুণরা ভয়াবহ সব অপরাধ ঘটাচ্ছে। নারী এদের কাছে ¯্রফে বলাৎকারের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু কেন এমন মূল্যবোধহীন অপরাধী তরুণের জন্ম হচ্ছে? কারণ এরা পরিবারে জন্ম থেকেই দেখছে অপরাধ, ঘুষ, লাম্পট্য, অবৈধ আয়, নারীর প্রতি সহিংসতা।
এদেশের এক শ্রেণির মানুষের হাতে প্রচুর অবৈধ টাকা রয়েছে। রয়েছে অপরাধ করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর দাপট, রয়েছে মূল্যবোধের মুখে ছাই দিয়ে প্রকাশ্যে লাম্পট্য ও সহিংসতা করে বেড়ানোর ঔদ্ধত্য। এরা দুর্নীতি করছে অবাধে। সেই টাকা তুলে দিচ্ছে পরিবারের হাতে। সেইসব পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরাও একেকটি ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব হয়ে সমাজকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে।
আমি যতই নিহত মেয়েটির কথা ভাবছি ততই বুকের ভিতর হিম হয়ে যাচ্ছে আতংকে ও বেদনায়। দিহানের পরিবার থেকে বারে বারে বলা হচ্ছে মেয়েটি নাকি ‘সম্মতি’ দিয়েছিল। প্রশ্ন করতে চাই, মেয়েটি কি ‘সম্মতি’ দিয়েছিল তাকে হত্যা করার? নিজের স্ত্রীকেও যদি কেউ যৌন সম্পর্কের সময় হত্যা করে সেটাও কিন্তু খুনই হয়। ভিকটিম ও ঘাতকের মধ্যে প্রেম, বিয়ে, বন্ধুত্ব যাই থাকুক কোনকিছুর দোহাই দিয়েই হত্যাকে জায়েজ করা যায় না। কতখানি পাশবিক ও নির্মম হলে একটি পুরুষ একজন নারীর শরীরকে এমনভাবে ছিন্নভিন্ন করতে পারে যে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। যদি ধরেও নেই, মেয়েটি সম্মতি দিয়েছিল, তবুও কি বলতে পারি যে সে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি? কতখানি যন্ত্রণা সয়েছে সে মৃত্যুর আগে? বাবা মায়ের কোলে আদরে বেড়ে ওঠা এই টিনএজ মেয়েটিকে দিতে হয়েছে বন্ধুকে বিশ্বাসের মূল্য, জীবন দিয়ে তাকে শোধ করতে হয়েছে একজন পারভার্ট ঘাতককে বিশ্বাস করার বোকামির মূল্য। সে বুঝতে পারেনি বন্ধুর ছদ্মবেশে রয়েছে একজন রেপিস্ট যে তার শরীরের ওপর, জীবনের ওপর এতটুকু মায়া করেনি, এতটুকু করুণা করেনি তাকে।
মেয়েটির কথা যতই ভাবছি ততই চোখে ভাসছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি ঘাতকশিবিরে বন্দি কিশোরী তরুণী বাঙালি নারীদের কথা। মনে হচ্ছে রক্ত ঝরছে বাংলার দেহ থেকে।
কিশোর গ্যাং এবং দিহানের মতো অপরাধীদের দমনে দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ, দরকার আইনের শাসন। এই দানবগুলো যেন কোনভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থের প্রভাব, পারিবারিক প্রতিপত্তির ছত্রছায়ায় অপরাধ করে বেড়াতে না পারে, রেহাই না পায় তাদের জঘন্য কৃতকর্মের দায় থেকে সেটা নিশ্চিত করা দরকার সবচেয়ে আগে। পাশাপাশি চাই সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা, চাই সমাজে আদর্শ স্থাপন।
আজকের শিশুরা কি দেখে বড় হচ্ছে? তারা দেখছে চারিদিকে ইয়াবা, ক্যাসিনো, নীতিহীনতা, অবৈধ রোজগার। শিশু বয়সেই দুর্নীতিবাজ অভিভাবকরা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে অবৈধভাবে উপার্জিত রাশি রাশি টাকা। কিশোর বয়সেই তারা অবাধে পর্নগ্রাফি দেখছে, নারীকে ভাবছে ধর্ষণের সামগ্রী, খিস্তি খেউড় করছে বড়দের সামনেই। তারা অবাধে অশালীন ভাষা ব্যবহার করছে। তারা নারীর প্রতি অবাধে ছুঁড়ে দিচ্ছে জঘন্য মন্তব্য। পরিবার থেকে শাসনের বদলে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। তাদের নামে কেউ অভিযোগ জানালে উল্টো তার মুখ বন্ধ করা হচ্ছে ক্ষমতা ও টাকার দাপটে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে কিশোর তরুণ অপরাধীর।
এখানে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কথাও একটু উল্লেখ করতে চাই নিদারুণ ক্ষোভের সঙ্গে। আমাদের সমাজে কোন নারী ধর্ষণ বা হত্যার শিকার হলেই শুরু হয় একদল মানুষের ভিক্টিম ব্লেইমিংয়ের পালা। ‘মেয়েটি কেন বন্ধুর বাড়িতে গেল?’, ‘মেয়েটির মনে হয় চরিত্র খারাপ’, ‘মেয়েটি প্রেম করত’, ‘মেয়েটির অভিভাবকরা তাকে একা চলাফেরা করতে দিত কেন?’, ‘মেয়েটি যৌনমিলনে সম্মতি দিয়েছিল’।
বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া, প্রেম করা, একা চলাফেরা করা কোনটিই কিন্তু আইনের চোখে অপরাধ নয়। আর সম্মতি দিলেও কাউকে খুন করার অধিকার জন্মায় না। খুন, ধর্ষণ হলো আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ। এখানে ভিক্টিমের চরিত্র হনন করে অপরাধীর অপরাধকে লঘু করার কোন অবকাশ কিন্তু থাকে না।
যতদিন সমাজ থেকে দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ, অপরাধীকে প্রশ্রয় দান বন্ধ না হবে, যতদিন আইনের কঠোর প্রয়োগ বন্ধ না হবে, যতদিন ক্ষমতার ছায়ায় কিশোর অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান বন্ধ না হবে, যতদিন অভিভাবকরা সচেতন না হবে ততদিন দিহানের মতো নরদানবদের জন্ম হতে থাকবে। তাসনুভা-হত্যাসহ প্রতিটি ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই, অপরাধীদের দ- কার্যকর হওয়া দেখতে চাই।
লেখক : সাংবাদিক