নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙামাটি :
যে হ্রদ ঘিরে আছে পার্বত্য শহর রাঙামাটিকে, যে হ্রদের পানিই এখন পুরো জেলার মানুষের খাবার ও ব্যবহার্য পানির প্রধান উৎস, ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেই হ্রদের নানান প্রান্তে দখল আর দূষণে দৃশ্যপট পাল্টে যাবার অভিযোগ বহুদিনের। রাঙামাটি শহর যত সম্প্রসারণ হয়েছে, ততই বেড়েছে হ্রদের দখল এবং দূষণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবকিছুকে ছাড়িয়ে আলোচনায় শহরবর্তী কাপ্তাই হ্রদ। যখন শহরের সবচে অভিজাত হিসেবে পরিচিত একটি ক্লাবের নিজস্ব ভবন পুরোটাই হ্রদের ওপর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব কাম কমিউনিটি সেন্টার’ নামের এই সাততলা নির্মিতব্য ভবনটির অর্থায়ন করছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, যার আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। যদিও নির্মাণ কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী জানালেন, এই টাকায় বড়জোর সাত তলা ভবনটির ছাদ ঢালাই দেয়া যাবে। পুরো কাজ শেষ করতে প্রয়োজন হবে আরো অর্থের। শহরের আবাসিক এলাকা হিসেবে খ্যাত তবলছড়ির লঞ্চঘাট এলাকার প্রবেশপথের হ্রদের সরু মোহনায় সম্পূর্ণ হ্রদের ওপরই নির্মিত হচ্ছে ভবনটি। শহরের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র টেক্সটাইল মার্কেট লাগোয়া ক্লাবটির পুরনো ভবন ও জায়গাকে অক্ষত রেখে তার পেছনে হ্রদের ওপর নির্মিত হচ্ছে এটি।
কেন এই অভিযোগ
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশলশাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফ্রেন্ডস ক্লাব নামের এই অভিজাত ক্লাবটির স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব কাম কমিউনিটি সেন্টার’ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি টাকা দরপত্র আহ্বান হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণ করে কার্যাদেশ পায় মেসার্স এসএস ট্রেডার্স নামের স্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে ক্লাবটির ভিত নির্মাণে ২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ২৫ লাখ বিল বাবদ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে আরো বরাদ্দের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জোর তদ্বির চলছে। সাততলা বিশিষ্ট এই স্থাপনার প্রতি তলার প্রতিটি ফ্লোর হবে সাড়ে ৪ হাজার বর্গফুট।
অনুমোদন নেই পৌরসভার
এদিকে পৌরসভা এলাকায় যেকোনো স্থাপনা নির্মাণে পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতির বিষয়টির আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ স্থাপনা নির্মাণে পৌরসভাকে অবহিত করা হয়নি বলে জানিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পৌরমেয়র ও দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে ‘বিব্রতবোধ’ করছেন। ভবনটি নির্মাণে পৌরসভার অনুমতি নেই স্বীকার করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষে নির্মাণ কাজের তদারকি করা উপসহকারী প্রকৌশলী এরশাদুল হক বলেন, এটি কেন, রাঙামাটিতে আমাদের নির্মিত কোন ভবনেরই তো পৌরসভার অনুমতি নেই, অনুমতি লাগে না। জেলা পরিষদ চলে তার নিজস্ব আইনে।’
যা বলছে ঠিকাদার
নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএস ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমি জেলা পরিষদের ঠিকাদার। পরিষদ যেখানে বলেছে, আমরা সেখানেই কাজ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ম অনুযায়ী জায়গার মালিক জেলা পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কত কিছুই তো হয়। আর এ ক্লাবের বিষয়টা তো একটু অন্যরকম। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সবাই উপস্থিত থেকে কাজটা করেছেন। প্রথমে কাজটি ১ কোটি টাকা বরাদ্দের ছিল, যা এখন ৩ কোটি টাকা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
ক্লাব কর্র্তৃপক্ষের কথা শুনছে না জেলা পরিষদ
রাঙামাটির সবচেয়ে ‘বনেদি’ আর ‘অভিজাত’ ক্লাব হিসেবে পরিচিত ফ্রেন্ডস ক্লাবের হ্রদ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে ক্লাব সভাপতি, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য চিংকিউ রোয়াজা বলেন, এমন একটি জায়গায় ক্লাব ভবনটি নির্মিত হচ্ছে, দেখে আমারও কষ্ট লাগছে। আমরা ক্লাবের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসককে কথা দিয়ে এসেছি, বর্তমান স্থান থেকে সরে আরো ২০/২৫ ফুট ভেতরে এসে নির্মাণ কাজ করব। সেই মোতাবেক ঠিকাদার ও জেলা পরিষদকে অনুরোধও করেছি। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শুনছে না।
যা বলছে জেলা পরিষদ
ক্লাবটির নির্মাণ কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা জেলা পরিষদের উপ সহকারী প্রকৌশলী এরশাদুল হক বলেন, যে টাকা টেন্ডার হয়েছে সেই টাকায় ক্লাবের পুরো নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। আরো বরাদ্দ প্রয়োজন হবে। বর্তমান অর্থবছযে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে তা দিয়ে খুব বেশি কাজ এগোনো যাবে না। আবার হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে কাজেও তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে। হ্রদের ওপর নির্মিত হওয়ায় খুব একটা সমস্যা হবে না।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী বিরল বড়–য়া জানান, আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। বরাদ্দ আনুযায়ী আমাদেরকে ক্লাব নির্মাণের জন্য যে জায়গা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে, সে স্থানেই নির্মাণ কাজ চলছে। সেটি খাস কিংবা বন্দোবস্তি জায়গা কিনা সে বিষয়টি আমরা দেখেনি। এখন ঊর্ধ্বতনরা যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ নেবো।
হ্রদ দখল করে সরকারি অর্থায়নে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি স্বীকার করে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বলেন, দেখুন পুরো রাঙামাটি শহরেই দখল চলছে। ফ্রেন্ডস ক্লাব কর্তৃপক্ষ যে স্থান দেখিয়ে দিয়েছে জেলা পরিষদের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা সেখানেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃষকেতু মনে করেন, হ্রদ দখল করে ক্লাবের স্থাপনা নির্মিত হলে ভবনের সামনের পাহাড়সহ আশপাশের পাহাড় ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে।
জেলা প্রশাসক বলেন
জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, নিখিল কুমার চাকমা ও চিংকিউ রোয়াজা আমার কাছে এসেছেন, তাদেরকে কাপ্তাই হ্রদ থেকে খুঁটি সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। তারা কথা দিয়েছেন, হ্রদ থেকে খুঁটি সরিয়ে ফেলবেন। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি কমিটি রয়েছে। হ্রদ সংক্রান্ত বিষয়াদি জেলা প্রশাসকই দেখেন। হ্রদের কতটুকু অংশে কিংবা রুলকার্ভ হিসেবে কতটুকুতে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, এসব। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, রাঙামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটির ভালো জবাব দিতে পারবেন। তবে বিষয়টি আমিও খতিয়ে দেখব।’
ক্লাবের সদস্য কারা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটির সদস্য হিসেবে যারা আছেন তারা সবাই জেলার প্রভাবশালী মানুষ। সদস্যদের মধ্যে আছেন রাঙামাটির বর্তমান সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, চারজন সাবেক ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, চিংকিউ রোয়াজা, নিখিল কুমার চাকমা ও বৃষকেতু চাকমা, রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলালসহ চেম্বারের একাধিক পরিচালক, রাঙামাটি ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন, রাঙামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম, রাঙামাটি পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান দীপুসহ শহরের বেশিরভাগ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষনেতারা। সর্বশেষ সদস্য হয়েছেন, এমন একজন দায়িত্বশীল জানিয়েছেন, ক্লাবটিতে সদস্য হতে তহবিলে ১ লক্ষ টাকা জমা দিতে হয়। তবে টাকা দেয়ার সামর্থ্য থাকলেই হবে না, অনুমোদন লাগবে ক্লাবের শীর্ষ নেতৃত্বের।