অমল বড়ুয়া »
দুই লাইনের বিখ্যাত অনেক কবিতা আছে। এই কবিতাকে ইংরেজিতে বলে কাপলেট, হিন্দিতে দোঁহা। বাংলায় অনেকে বলে দ্বিপদী। যদিও দ্বিপদী মূলত সে কবিতাকে বোঝায় যার প্রতি চরণে দুটি অংশ (পদ) থাকে, হোক সেটা দুই লাইনের বা তারও বেশি। কাপলেট হচ্ছে দু-লাইনের কবিতা বা দুই লাইনের শ্লোক। আর এই কাপলেট কবিতার দুটি লাইনেরই বিস্তার এবং বিন্যাস সমমাত্রিক। ‘কাপলেট’ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ থেকে যার অর্থ ‘দুটি লোহার টুকরো একসাথে বাঁধা বা আটকানো।’ এই ‘কাপলেট’ শব্দটি প্রথম ১৫৯০ সালে স্যার পি. সিডনির আর্কেডিয়ায় পদ্যের ধারাবাহিক পঙক্তি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বাংলায় কাপলেট’র সূচনাকারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বলতে হয় সবার আগে। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেখানে দুই লাইনের বেশ কিছু বিখ্যাত কাপলেট আছে। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য রচনার ‘অন্তবর্তী পর্ব’-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা যায় ‘কণিকা’ কাব্যে। নীতিশিক্ষামূলক কাপলেটগুলো কণিকাকে বেশ উপাদেয় করেছে। তবে বাংলা অঞ্চলে দুই চরণের ছড়ার প্রচলন রয়েছে হাজার বছর আগে থেকে। দোঁহা, খনার বচন, আঞ্চলিক প্রবাদ ইত্যাদি এর অর্ন্তভূক্ত। কাপলেট হল একটি কাব্যিক কৌশল যা দুটি লাইন নিয়ে গঠিত এবং একে অপরের সাথে ছন্দবদ্ধ হয়। লাইনগুলি পূর্ববর্তী বিষয়বস্তুর সারাংশকে ধারণ করে, একটি চূড়ান্ত চিন্তা বা প্রতিফলন প্রদান করে যা কবিতার সামগ্রিক অর্থকে উন্নত করে। কাপলেটে দুই লাইনের মধ্যে গভীর দর্শনকে প্রকাশ করতে হয় তাই ভাবগম্ভীর অক্ষরবৃত্ত ছন্দই কাপলেটের জন্য যথাযথ ও উপযুক্ত। বাংলা ভাষায় লিখিত বেশিরভাগ কাপলেটই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়। অক্ষরবৃত্তের পর বেশি ব্যবহৃত হয়েছে স্বরবৃত্ত ছন্দ। তাছাড়া মাত্রাবৃত্ত ছন্দ ও গদ্যছন্দেও ভালো কাপলেট লেখা যায়। এছাড়াও কাপলেট হতে পারে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, প্রবচন, প্রশ্নবোধক, হাস্যরসাত্মক বা ব্যঙ্গাত্মক, প্যারাডক্স কিংবা ননসেন্স প্রকৃতির কবিতা।
তরুণদের মধ্যে অন্যতম একজন হলো আকবর চৌধুরী, যার কাপলেট ভালোলাগার আবেশ জাগায়, শব্দ ঝঙ্কারের অনির্বচনীয় ছোঁয়ায় বিমোহিত করে অন্তর-অতল, পরিব্যাপ্ত করে বুকের গহীন। তার কাপলেটের অর্থব্যঞ্জনায় সমকালীনতা, জীবনবোধ, প্রেম ও দর্শন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। যেমন-
মুখ ও মুখোশের ভিড়ে মানুষের নেই দেখা
চারদিকে কোলাহল তবু দ্বীপের মতো একা।
অথবা সমকালীনতাকে তুলে ধরতে তার অন্য আরেকটি কাপলেট আরও কার্যকরী ও শক্তিশালী মনে হয়েছে।
চলছে মূল্যপ্রিয় যুগ, সবাই যেন জগৎস্বামী
প্রমাণ করতে মরিয়া, কে কার চেয়ে দামি।
কবি কেবল কল্পনায় অভিরমিত নয়। জাগতিক বাস্তবতার পরম-সত্যের পরাকাষ্ঠে নিজেকে সঁপে বোধ ও বোধিকে প্রকাশেও দ্বিধাহীন নিঃসংকোচ।
সুর্য কতটা আলো দিয়েছে নিজকে সেঁকে
অন্ধজনের কী ফায়দা ? সেই হিসাব রেখে।
অথবা
জীবনকে দেখতেই আরেক জীবনে ভর করে
কেউ দেখে কেউ না দেখে ফিরে মাটির ঘরে।
জীবনবোধ কবির কবিতার মূল উপজীব্য। বাস্তবতার নিরিখে জীবন-সত্যকে প্রকাশের মধ্যেই কবির মননশীলতা প্রকট হয়ে ওঠে। এই জীবন অনিত্য, ক্ষণভঙ্গুর ও নিয়ত লয়ের পথে ধাবমান। জীবনদর্শনের সবচেয়ে বড় সত্য- তার ক্ষয়ে যাওয়া। আর এই চরম সত্যের অনুগামী কবি আকবর চৌধুরীর ঋজু উচ্চারণ-
বেঁচে থাকার সব হায়াত কবরের কাছে বেচে
জীবন থেকে জীবনটাও অসময়ে চলে গেছে।
কাপলেট কেবল শব্দের সাথে শব্দের বিনিসুতার বন্ধন নয়, বরং আত্মদর্শনের মমার্থ প্রকাশের জটিল ধাঁধা, শিল্পশৈলীর অনুপম বুনন। দুই চরণের মধ্যে নিজের সমস্ত ভাবনা-চিন্তা ও দর্শনকে শব্দ-ইন্দ্রজালে, ছন্দে গেঁথে গেঁথে মূর্ত অবয়ব গড়ে চিত্রকল্প নির্মাণ করা। আর এর নির্মাণ উপকরণ হলো বিবিধ রহস্যরসযুক্ত রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, যা কাপলেটের প্রতিটি চরণে বিধৃত হবে। এক্ষেত্রেও নবীন কবি আকবর চৌধুরীর দক্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
আমি ও পাখি মুখোমুখি থাকি, নেই গল্প
নক্ষত্রও দুঃখ আনে এখানে, সুখটা অল্প।
কিংবা
নদী নই, তবু কতটা পানি চোখের বাঁকে
নির্গত প্রতি ফোটা কেবল তারেই আঁকে।
অথবা
ঝরতে থাকো ভরদুপুরে, বৃষ্টিরা যেমনি ঝরে
পাতাঝরা বৃক্ষতলে কিংবা ভাঙা চালের ঘরে।
কবিরা প্রেমিক হয়। প্রেমিক না হলে কবির শব্দরা ছন্নছাড়া, হতবিহ্বল, অগোছালো ও দিশেহারা হয়ে যায়। তাই বলা যায়, সব প্রেমিক কবি নয়, তবে সব কবিই প্রেমিক।
প্রেমভিক্ষু আমি, কত কষ্টে ছুটি তার পানে
মৌমাছি যেমনি বনবাদাড় ছুটে মধুর টানে।
অথবা
কতজন কতকিছু চায়, কতকিছুর আশা করে
কেবল আমি তোমাকে চেয়েছি আমার একলা ঘরে।
কবির বোধশক্তি প্রবল। তাই তাদেও আবেগ অনুভুতিও প্রবল। নিরঞ্জন জীবনের প্রতি আসক্ত না হলেও কবিরা সর্বজনীন এবং উদার। কবি কণ্ঠে সবসময় প্রতিধ্বনিত হয় ত্যাগমহিমার জয়গান।
যেটুকু অন্ধকার, যেটুকুতে পৌঁছে না আলো
ওটুকু আমার হোক, আমি অন্ধকারে ভালো।
অথবা
তোমায় যাপন করতে করতে নিজকে ভুলে
ফুল ভেবেই ঝুড়ি ভর্তি করলাম কাঁটা তুলে।
কবির পুরো জীবনটাই ফুরিয়ে যায় সত্য-সুন্দরের আরাধনায়। শুদ্ধতার খোঁজে কবির বিচরণ এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের চরাচরে। তাই তো তারা ধ্বংসের মধ্যেও সৃষ্টি, দুঃখের মধ্যেও সুখ আর পঙ্কিলতার মাঝেও খোঁজে নেয় অমল শুভ্র-শুদ্ধতার আবেশ।
ভেঙ্গে যদি শান্তি পাও ভাঙতে থাকো রোজ
ভাঙ্গা টুকরোয় কেউ করবে শুদ্ধতার খোঁজ।
কবির শক্তি অপরিসীম। সেই শক্তি বোধের, শুদ্ধতার, শাশ্বত জাগরণের আর সৃজনের। কবির শক্তিমত্তার পরিচয় তার সৃজনে। কবির আয়ুষ্কাল নির্ভর করে পাঠকের মনোজগতে ঐন্দ্রিজালিক আবেশের অনুরণন সৃষ্টির দক্ষতার ওপর। কবি আকবর চৌধুরী মেধাবী তরুণ কবি। আশা করি তার উদ্যোম আর সৃজনশীলতা তাকে বহুদুর নিয়ে যাবে। ‘কাপলেট’ নামক আকবর চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থটি দেশের স্বনামধন্য প্রকাশনী অক্ষরবৃত্ত থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মুদ্রিত মূল্য দুইশত টাকা আর প্রকাশকাল ২০২৪। আশাকরি কবিতাপ্রেমি বোদ্ধা পাঠকমহল বইটি পড়ে অনুরণিত হবেন।