দেশে কর্মবান্ধব পরিবেশের ঘাটতি শ্রমিকমৃত্যু বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর এক জরিপ প্রতিবেদনে এ চিত্র ওঠে এসেছে। ওই জরিপ জানাচ্ছে, বিদায় নেওয়া ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর ধরনের মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনা ও নির্যাতন। বিলস-এর জরিপ বলছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের অধিকাংশই হলো পরিবহনখাতের। নির্যাতনে নিহত শ্রমিকদের মধ্যেও বেশির ভাগই পরিবহন সংশ্লিষ্ট পেশায় জড়িত। দেশের প্রথমসারির কয়েকটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে ‘কর্মক্ষেত্র পরিস্থিতি জরিপÑ২০২০’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ৭২৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩৪৮ জনই পরিবহনখাতের। এছাড়া এ তালিকায় রয়েছে ৮৪ জন নির্মাণশ্রমিক, ৬৮ জন কৃষিশ্রমিক, ৫৯ জন দিনমজুর। এখানে শ্রমিক মৃত্যুর বড় কারণ হিসেবে ওঠে এসেছে সড়ক দুর্ঘটনা। দ্রুতগতিতে গাড়িচালনা, চালকের মাদকাসক্তি, অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিবহনখাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও অনেক শ্রমিক মারা গেছে। এক্ষেত্রে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎলাইন স্থাপন, অসাবধানে কাজ করা ও সাধারণ দক্ষতার অভাব। একই প্রতিবেদনে বিলস-এর পর্যবেক্ষণ হলো, নির্যাতনেও বহু শ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এখানেও পরিবহনখাতে মুত্যুর সংখ্যাই সর্বাধিক, ৯০ জন। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিকের তালিকায় আছে অভিবাসী শ্রমিক ৫২ জন, পোশাককর্মী ২৫ জন, গৃহকর্মী ১৬ জন, নিরাপত্তাকর্মী ১০ জন, কৃষিশ্রমিক ৪২ জন, নির্মাণশ্রমিক ৮ জন, দিনমজুর ১১ জন, মৎস্যশ্রমিক ১১ জন এবং ৫৭ জন অন্যান্য খাতের।
সাধারণভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণির রয়েছে দুর্বিষহ জীবনযাপনের করুণ অভিজ্ঞতা। সঠিক মজুরি না পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা, মালিক কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণ, সময় মতো চিকিৎসা না পাওয়া ইত্যাদি তাদের জীবনে অভিশাপের মতোই হয়ে আছে। তাদের স্বার্থের দেখভাল করার জন্যে যে সংগঠন-সমিতিগুলো রয়েছে, এসবের নেতাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। আপোষকামিতা, সুবিধাবাদিতা ও শ্রমিকস্বার্থের প্রতি তাদের রয়েছে ব্যাপক নির্লিপ্ততা।
সামগ্রিকভাবে বিলস-এর এই প্রতিবেদন সচেতন মানুষকে ব্যথিত করবার জন্যে যথেষ্ট। শ্রমিকেরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে, তাদের সন্তান-সন্ততির মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেবার আশায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও তাদের কর্ম পরিবেশে থাকে না প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
সংশ্লিষ্টদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শ্রমিকের শ্রম তার বিনিয়োগকৃত শিল্পে বা ব্যবসায় জীবন্ত উপাদান। সকল ধরনের যন্ত্রচালনায় নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তার নিশ্চিতের পাশাপাশি কর্মবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা মালিক-কর্তৃপক্ষের তাই নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এক্ষেত্রে দায়সারা মনোভাবের পরিচয় দিলে অসাধূ মালিক-কর্তৃপক্ষ শ্রমিকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে কসুর করবে না। তাই সরকারকে এখানে শ্রমিকের দরদি অভিভাবকরূপে সর্বক্ষণ সজাগ থেকে তাদের জন্য কর্মবান্ধব পরিবেশের সুরক্ষা দিতে হবে।
মতামত সম্পাদকীয়