মনসুর নাদিম »
কৃষাণ তো মইরা গেছে। জমিনটা পইড়া রইছে অনেকদিন। আমি আবার বর্গা চাষ করি। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ফজর আলী পান চিবুতে চিবুতে নুরুন বেওয়াকে শোনায়ে শোনায়ে কথাগুলো বললো। নুরুন বেওয়া ঘর্মাক্ত ফর্সা মুখটা আটপৌরে শাড়ির আঁচলে মুছে হনহন করে ফজর আলীর সামনে দিয়ে চলে গেল। ফজর আলী যে এই কথার মাঝে কী ইংগিত করেছে নুরুন বেওয়া টের পেয়ে গেছে। নুরুন বেওয়া কে পাঁচ বছর আগে বিয়ে করতে চেয়েছিল ফজর আলী। নুরুন এর বাপ রাজি হয় নাই। টাকা থাকলে কী হয় ? ফজর আলীর স্বভাবটা ভালো না। মেয়ে মানুষ দেখলেই আকারে ইংগিতে কত খারাপ কথা বলে দেয় ? নুরুন তার কথার মতলব ভালো করেই বোঝে তা ফজর আলীও জানে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় হাসমত নুরুনের কোলে সিফাত আর রিফাতকে দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল। ডেঙ্গুতে মরেছিল হাসমত। দাদীর মুখে শুনেছে পাকিস্তান আমলে হেলিকপ্টারে করে নাকি ধানের ওষুধ মশার ওষুধ ছিটাতো । এখন মশার কামড়ে মানুষ অতিষ্ঠ কিন্তু মশা নিধনের কর্মসূচি কাগজে কলমে ঘুরছে। হাসমতের মৃত্যুর পর নুরুনের ভরা স্বাস্থ্যের দিকে আবারো নজর পড়েছে ফজর আলীর। ঘরে দুই বউ। মেয়ে বিয়ে তা। তব্ওু যেন রাস্তায় বের হলে কার্তিকের সারমেয়দের মতো জিব বের করে এটা সেটা শুঁকতে থাকে। পুরুষ মানুষের স্বভাবটাই এরকম। আকাশে মেঘের ভেলা ভাসছে। কখন জানি বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি হলে নুরুনের ঘরের মেঝে ভেসে যাবে। কয়েকটা টিন বদলাতে হবে। সেই কবে দশ বছর আগে নুরুনের শ্বাশুর তাল মার্কা ঢেউ টিন দিয়ে ঘর বানাইছিলেন। মার্কা তাল হোক আর বেতাল হোক, এক টিন দিয়ে তো আর জনম যাবে না। নুরুনের বিয়েও হয়নি তখন। বিয়ের একবছর পর শ্বশুর মারা গিয়েছিলেন ক্যানসারে। শ্বাশুরিকে দেখে নাই নুরুন। ঘোমটা টা টেনে দিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটল নুরুন।
বর্ষায় পথঘাট কাদায় প্যাক প্যাকে পিচ্ছিল। ছাতা মাথায় সাবধানে পা ফেলছে মিন্নত আলী কন্ট্রাক্টর। হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি কুয়াশার মতো বৃষ্টি পড়ছিল। রাবেয়া গরুটাকে টানতে টানতে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। মিন্নত আলিকে দেখে, ঐ মিন্নত দাদা খাড়ান। আপনের লগে কথা আছে। মিন্নত আলী কন্ট্রাক্টর ঘোলাটে চশমার ফাঁক দিয়ে রাবেয়াকে দেখে বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বলল-গরু নিয়ে যাওয়ার আর লোক নেই। তুমি পারবে এই গাইটাকে টেনে টেনে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে ?
প্রতিদিন তো আমিই নিই। আইজকেও নিবো। এখন কওন দেহি আমগো রাস্তার মাথার পুলটা কবে কমপ্লিট অইব ? রাবেয়ার ঝাঁঝালো কণ্ঠের প্রশ্নের উত্তর কী দেবে মিন্নত আলী ভেবে পায় না। করোনা কালের ক্রান্তি লগ্নে চারিদিকে স্থবিরতা বিরাজমান। অর্থনৈতিক মন্দাভাব। বড় বড় রাঘব বোয়ালেরা মুখে নিঃশ্বাস ফেলছে। মিন্নত আলীর কয়েকটা বিল আটকে আছে। শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না। চারিদিকে এক নীরব হাহাকার। মিন্নত আলী ঠিকাদারি করে ভাত খায়। প্রতিদিন নানা জাতের মানুষের সাথে হয় তার ওঠা বসা। চুন খয়েরে বিবর্ণ দন্তাপাটি দর্শনে বললো-হয়ে যাবে, এই একটু করোনা সংকট চলছে তো। ধীরে ধীরে কাজ হচ্ছে। তোমার কাছে বিক্রি করার পশু আছে নাকি ? মিন্নত আলী রাবেয়াকে পুলের কথা ভুলিয়ে দিতে এই অপ্রাসঙ্গিক কথাটা বলেছিলেন। পলিটিশিয়ানদের সাথে ওঠা-বসা করতে করতে পলিটিক্স এর কিছু পাঠ নিয়ে নিছে। রাবেয়াও কম যায় না। একটু মোলায়েম কণ্ঠে ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল-কেন দাদা ? পশু দিয়ে কী করবেন ? মিন্নত আলী তেমনি হেসে বলে- কোরবানির মাসে পশু দিয়ে মানুষ কী করে ?
– কোরবানি করে।
– আমিও তাই করবো। পশু তো আর বিয়ে করার জন্য নয় ?
– বিয়ের নাম নিছেন তো ঝাঁটা হাতে দাদী বসে আছে। হি হি হি। মিন্নত আলী এদিক সেদিক দেখে নিচু স্বরে বলল-তোমারে তো বলছিলাম আমার দ্বিতীয় বউ হতে।
– উহ শখ কতো । আমি কইছিনা আপনেরে, আমি সতীনের ঘর করুম না। বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেল। ঝম ঝম করে মুষলধারে শুরু হল। রাবেয়া গরু নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়তে লাগলো। ভিজে শাড়িটা দেহের সাথে একেবারে লেপ্টে গেল। মিন্নত আলী রাবেয়াকে নিজ ছাতার নীচে ডাকতে লাগলো। মিন্নত আলীর চোখ রাবেয়ার ভেজা দেহের মাপ জোঁক করতে ব্যস্ত হয়ে গেল ।
সিফাত রিফাতকে দুটি পেয়ালায় মুড়ি খেতে দিয়ে নুরুন জ্বালানি কাঠগুলো ছোট ছোট আঁটি করে বাঁধছিল। কখন যে পিঠের ওপর এসে মেহের আলী দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি নুরুন। হঠাৎ নাকে সিগারেটের গন্ধ লাগতেই ফিরে দেখে মেহের আলী একেবারে পিঠের সাথে লেগে দাঁড়িয়েছে। বউমা কী করো?
নুরুন বেওয়া জবাব দেয় না। এই পুরুষ জাতটার ওপর নুরুনের ঘৃণা এসে গেছে। মেহের আলী হাসমতের আপন চাচা। হাসমত মরার পর খোঁজ খবর সাহায্য সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি করেছে মেহের আলী। কিন্তু কে জানতো তার মনেও পাপ। নুরুন বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একা থাকে। একমাত্র ননদ রাবেয়া সারাদিন গ্রামময় টোঁ টোঁ করে। মেহের আলী একটু কেশে আবারো জিজ্ঞেস করলো- বউমা, রাবেয়া কোথায় দেখতেছি না যে। শরীরের অনাবৃত অংশ শাড়ি দিয়ে ঢেকে নীচু স্বরে বলল- এখানেই তো ছিল চাচা। মেহের আলীর চোখ নুরুনের সারা দেহে যেন সফর করছে। ঘন ঘন খোঁজ খবরের নামে মেহের আলীর আসা যাওয়া এ বাড়িতে বেড়ে গেলেও নুরুন কিছু বলতে পারে না। অভাব মানুষের চিত্ত দুর্বল করে দেয়। অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়। মেহের আলীর অযাচিত যাওয়া আসা, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসা কোনোকিছুই নুরুনের পছন্দ না। কিন্তু সইতে হয়। মেহের আলী চাচার বয়স চল্লিশ হবে। এই বয়সের পুরুষেরা খুবই বিপজ্জনক। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে বাইরে সুখ তালাশ করে। একা পেলেই নুরুনকে সংসারে অসুস্থ বউয়ের কথা বলে। ইনিয়ে বিনিয়ে নুরুনের করুণা চায়। মাঝে মাঝে নুরুন বলেই ফেলে “ ছি চাচা, এগুলো আমারে কী কন ? আমি না আপনার পুত্রবধূ”? মেহের নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে হেসে বলে- তোমাকে বলে মনটা একটু হালকা করি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- পুত্র তো নাই। থাইকলে কী আর এরকম বেয়াড়া হইতাম ? রাবেয়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মেহের দাঁড়িয়ে গেল। আমি যাই বউমা। ঐ যে পাড়া বেড়ানি আইসা গেল। তারে আবার এগুলো কিছু কইও না কইলাম। বাচ্চা মানুষ। আবার কী মনে করে। নুরুন মুখ টিপে হাসে।
রাবেয়ার কোমরে পা তুলে সিফাত ঘুমায়। রাবেয়ারও বালিশ থেকে মাথা এলিয়ে পড়েছে। রিফাত এখনো চুকচুক করে নুরুনের বুকে মুখ ঘষছে। রাত কতো হবে অনুমান করতে পারে না নুরুন। মাঝে মাঝে খোলা চোখেই ভোর হয়ে যায়। আকাশ-পাতাল ভাবনা। মানুষের জীবন কত কষ্টের নির্যাস। মানুষ বড় অসহায়। বিশেষ করে একা মেয়ে মানুষ । নুরুনের শ্বশুর সবসময় বলতেন, গরিবের সুন্দরী বউ সকলের ভাবি হয়। সাবধানে থাইকো বউমা। সবার সাথে কথা বলার দরকার নাই। বাইরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। নুরুনের কপালে জলের ফোঁটা পড়ছে। কটা টিন বদলানোর দরকার ছিল। বৃষ্টি হলে সারা ঘরে বিক্ষিপ্ত ভাবে পানি পড়ে। হাঁড়ি পাতিল বালতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসায়ে দিতে হয়। রাবেয়া নড়েচড়ে উঠে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে- আসমান কী ছেদা অইয়া গেলো নাকি, এতো পানি ঝরে ক্যান? নুরুন আনমনে বলে, যার কপালটাই ছেদা তার জন্য আসমান ছেদা হোক আর চাল ছেদা হোক কোনও তফাৎ নাই। রাবেয়ার আবার মৃদু নাসিকা গর্জন আরম্ভ হল। নুরুন আবারও ভাবনায় পড়ে গেল। একদিকে ফজর আলী অন্যদিকে মেহের আলীর উৎপাতে নুরুনের জীবনটাই যেন মরা গাঙ্গে আটকে আছে। হঠাৎ বুদ্ধির জানালা খুলে গেল নুরুনের। এই দুই লম্পট থেকে বাঁচতে হলে সকাল থেকে করোনা রোগীর অভিনয় করতে হবে নুরুনকে। জানের মায়া বড় মায়া। এই করোনায় নিজ মা-বাপকে ফেলে সন্তানেরা পালাচ্ছে। দাফন কাফন কিংবা সৎকারে স্বজনেরা এগিয়ে আসছে না। এইতো সুযোগ। অন্তত কিছুদিন একা থাকতে পারব।