সুভাষ দে »
করোনাকালে অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান হলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর অবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষ গভীরভাবে অনুভব করতে পারছে না, এমন কি অভিভাবকের দারিদ্র্য ও অসহায় অবস্থায় তাঁরা গভীর হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন সন্তানদের শিক্ষা ও নিজের পরিবারের অনিশ্চিত অবস্থার কথা ভেবে। অথচ শিক্ষার ক্ষেত্রে এই ক্ষতি জাতি গঠন ও মানবসম্পদ তৈরিতে যে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করতে চলেছে, সে ব্যাপারে জাতির মনোযোগ ও করণীয় নির্দিষ্ট করা না হলে আমাদের ব্যাপক খেসারত দিতে হবে এবং তা আগামী দিনে অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়নকে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই এ ব্যাপারটিতে জাতীয় নীতি নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা ও করণীয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেই সাথে আগামী বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টিতে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
করোনার কারণে গত ১৪ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ রয়েছে। করোনা মহামারি কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে এখনও পরিষ্কার নয় এবং বিশেষজ্ঞরা তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কথাও বলছেন। এ ধরণের একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কিভাবে শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারে স ব্যাপারে ক্লাসের বিকল্পগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে যদিও কিছু বিকল্প চালু হয়েছে, তার সুফল সকলে পাচ্ছে না কিংবা এর ফলাফল কিরূপ হবে সে ব্যাপারেও গবেষক ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক-কর্মচারী করোনাকালে ক্ষয়ক্ষতি ও অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিশুকিশোরদের বিশেষ করে শহরের শিশু কিশোররা স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে রয়েছে। খেলাধূলা, বিনোদন, ভ্রমণ, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা শারীরিক ও মানসিক চাপে বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে। স্কুল, সহপাঠীদের সাথে মেলামেশা তাদের জীবনের এই প্রাথমিক অবস্থাকে সতেজ ও পুষ্ট রাখে, শিক্ষাজীবনের ভিতটিও এই সময় রচিত হয় অথচ তারা এ সব থেকে বিচ্ছিন্ন দীর্ঘদিন ধরে। সেই সাথে অভিভাবকদের করোনাকালে অর্থনৈতিক অবস্থার চরম অবনতি, অনেকের শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
শহরের দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়ার ব্যাপারটি সরিয়ে রেখে আয়Ñ রোজাগারের পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। আবার গ্রামের অবস্থা অনেকটা একই রকম, কিশোরীদের অল্প বয়সে করোনার সময় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অসহায় অভিভাবকদের এ ছাড়া উপায়ও নেই। কিশোর তরুণরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় বেপথু হচ্ছে। শহরেÑগ্রামে কিশোর অপরাধ বাড়তে শুরু করেছে। শহরে কিশোর গ্যাংদের দৌরাত্ম্য পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে। যে বয়সে এরা স্কুলে যাওয়ার কথা বইখাতা নিয়ে, সেই বয়সে এলাকায় নানা অপরাধ-দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতি এবং এলাকার ‘বড় ভাই’রা তাদের মদদ দিচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে, গবেষণায় দেখা গেছে করোনাকালে অপরাধ বেড়েছে, এসব সামাজিকভাবে নানা ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রাথমিকের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনার এই সময়ে নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে রয়েছে। (সূত্র : সমকাল ২৩ মে’ ২০২১) এ গবেষণায় কয়েকটি মৌলিক দিক উঠে এসেছে, এগুলো হল, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া, শিক্ষার খরচ তুলনামূলক বেড়ে যাওয়া, স্কুল খোলার সময় নিয়ে চিন্তা এবং পড়াশোনার পাশাপাশি কর্মসংস্থানজনিত উদ্বেগ। গবেষণায় শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়গুলির ব্যাপকতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে আলোচনা পর্যালোচনা একেবারেই কম হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষা অধিদফতর অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলির পর্যালোচনা নিবিড়ভাবে করছে কিনা সন্দেহ।
দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা ভর্তি পরীক্ষা সবই নিচ্ছে, তাদের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পাশ করে বেরুচ্ছে, চাকরির বাজারও তারা আগে ধরবে, পক্ষান্তরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারি- বেসরকারি কলেজ, মেডিক্যাল, কৃষি, ভেটেরেনারি, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এসব জায়গায় সেশনজট প্রবল হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের চাকরির বয়স পেরিয়ে যাবে, বেকারত্ব প্রকট হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা স্থগিত হয়ে আছে। গত বছর এসএসসিতে পাশ করা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও ক্লাশ করতে পারছেনা। এবার এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেও একই পরিস্থিতি। অটোপাশ কাম্য নয়। এতে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠ গ্রহণে অসুবিধা হবে, পিছিয়ে পড়বে তারা বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এতে বৈষম্যও বাড়বে প্রবল। শহরে অনলাইনে কিছু ছেলেমেয়ে ক্লাস করলেও তার সুফল সকল শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। আমাদের দেশে পড়াশোনা শ্রেণিকক্ষ নির্ভর। বিকল্প আমরা কখনো চিন্তা করিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অনেকেই শিখন শেখানো কার্যক্রম থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে যা লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহের সৃষ্টি করবে।
শহরের অভিভাবকরা কিছুটা সচেতন বলে সন্তানদের নানাভাবে পড়ায় যুক্ত রাখছে পারছে কিন্তু গ্রামের অভিভাবকরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন। সরকার অনলাইন বেতার ও টেলিভিশন মারফত শিখন কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার সুফল কম।
করোনার এই দীর্ঘ সময়ে স্বউদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা অসহায়ভাবে, কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছেন, অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন, এ ক্ষেত্রে সরকার থেকে যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে তা একেবারেই সামান্য।
শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া বর্তমান শিক্ষাক্ষেত্রে আগোছালো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সংস্কার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে দুপুরের খাবার, অভিভাবকের দারিদ্র হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাতা, শিক্ষকÑকর্মচারীদের প্রণোদনা, শহর ও গ্রামাঞ্চলে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়ানো, এসব দিকে সরকারকে ব্যাপক উদ্যোগের কথা ভাবতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। করোনাকাল দীর্ঘায়িত হলে অনলাইন পাঠদান, ভার্চুয়াল ডিজিটাল ক্লাসরুম লাগবে। ব্যাচ করে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা চিন্তা করতে হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের বিষয় চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা মনে করি শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে জাতীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক পর্যালোচনা প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক