ড. সন্তোষ কুমার দেব »
স্বাধীনতার ৫০তম বছরে বাজেটের আকার দাঁড়ালো ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার থেকে ৭৬৮ গুণ বেশি। প্রতি বছর নতুন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্রত্যয় থেকে জুন মাসে বাজেট ঘোষণা হয়। আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে জনপ্রশাসন, তারপর শিক্ষা প্রযুক্তি খাত।
২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতে ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটের শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত বাজেটের চেয়ে ৩৬৪ কোটি টাকা বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৬ ৬৮ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। করোনা মহামারি প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০২১-২২ অর্থবছরে পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। করোনাকালে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে পর্যটন খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বিগত বছরের তুলনায়। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এ পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ এই অর্থবছরের বাজেটে ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে বিগত বছরের তুলনায়।
করোনা মহামারির প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বজুড়ে বাজেটে জীবন-জীবিকা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার কিছু দিন পর থেকে লকডাউন শুরু হয়, যার ধারাবাহিকতায় পর্যটন শিল্পের ব্যবসা-বাণিজ্যে ছন্দপতন শুরু হয়। ২০২০ সালে দীর্ঘদিন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকার পর আগস্ট মাস থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ার পর কিছুটা ছন্দে ফিরতে শুরু করে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বাণিজ্য। তবে বাদ সাধে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ায় লকডাউন শুরু হওয়ায় আবার দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে।
ইতোমধ্যে লকডাউন শিথিল করা হলেও বিধিনিষেধ বিদ্যমান থাকার কারণে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে এবং করোনা যদি আরও দীর্ঘায়িত হয় পর্যটন শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অনন্য ভূমিকা ছিল পর্যটন শিল্প। ২০১৯ সালে সমগ্র বিশ্বে পর্যটক ছিল ১ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন এবং এ খাতে হয়ে আয় হয়েছে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপি অবদান ১০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং এই শিল্পে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন লোকবল কর্মরত রয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটক ১ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে বিধায় জিডিপিতে অবদান ছিল ৪.৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে ৪০ লাখের অধিক জনবল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কর্মরত রয়েছেন। প্রতি ১০ জনে ১ জনের কর্মসংস্থান হয় এই শিল্পে। ২০২০ সালে পর্যটন শুভবার্তা দিয়ে শুরু হয়েছিল। বিশ্বের পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত পর্যটক সংখ্যা ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছিল পর্যটনশিল্প, করোনা মহামারির ফলশ্রুতিতে সেই প্রত্যাশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সূত্র অনুযায়ী, এ বছর জুলাই মাস পর্যন্ত করোনা মহামারি বৃদ্ধি পেলে বিগত বছরের তুলনায় ৫৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হলে ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমবে বিগত বছরের তুলনায়, যা পর্যটন শিল্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বে ইতোমধ্যে এ শিল্পের ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন লোকবলের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, মহামারির কারণে বাংলাদেশ পর্যটন খাতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখীন। ক্ষতিগ্রস্ত এই খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা করোনাকালের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটন শিল্পের বিকাশে অপ্রতুল। এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মুষ্টিমেয় অংশ চলে যাবে বেসামরিক বিমান চলাচল খাতে, বাকি অংশ ব্যয় হবে পর্যটন উন্নয়নে।
পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে বাজেটে বড় অঙ্কের বরাদ্দের পাশাপাশি থোক বরাদ্দ প্রয়োজন এই সংকট মোকাবিলা করে টেকসই পর্যটন বিনির্মাণে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো পর্যটনের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ প্রয়োজন। এক বছরের অধিক সময় করোনা মহামারি চলমান থাকায় পর্যটন খাতে প্রণোদনা অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা, পর্যটন পণ্যের ভ্যাট, ট্যাক্স হ্রাস করা নতুন ব্যবসায়ীদের জন্য টেক্স হলি-ডে বৃদ্ধি করা, ভার্চুয়াল ট্যুরিজম এবং ট্যুরিজমের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
করোনায় মানুষের আয় কমে যাওয়ায় বিনোদন ও ভ্রমণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, এমনকি ভ্রমণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি এখন অধিক গুরুত্ব পায়। তাই করোনার প্রভাব যদিও স্বল্প সময়ে হ্রাস পায়, পর্যটন শিল্পের আগের অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ বছর। দেশের ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে পর্যটন খাতকে সংকট থেকে বের করে আনার জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ ও পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। সংকট উত্তরণে ও পর্যটন বিকাশে সরকারি সহায়তা ও দিকনির্দেশনার বিকল্প নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও পর্যটন বিশেষজ্ঞ,
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়