বিবিসি বাংলা :
করোনাভাইরাস চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্লাজমা থেরাপির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
শনিবার করোনাভাইরাসে সুস্থ হওয়া কয়েকজন ব্যক্তির শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে এই প্লাজমা পরীক্ষানিরীক্ষার পরে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের থেরাপি দেয়া হবে।
বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি শুরু করা হয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি হাসপাতালে কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান (এম এ খান) বলেছেন”শুরুতে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৪৫ জন রোগীর ওপর এই থেরাপি প্রয়োগ করবো। তারপর আমরা তাদের উন্নতির বিষয়টি পর্যালোচনা করবো। পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্যান্য রোগীদের ওপর প্রয়োগের বিষয়টি আসবে।”
বাংলাদেশে আপাতত এই চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে। সফলতা পাওয়া গেলে করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসায় এটি পুরোদমে শুরু করা হবে তিনি জানান।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি বেশ পুরোনো একটি পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে সাধারণত কোন ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা মানুষের রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই রক্ত সঞ্চালিত করা হয় একই ধরনের ভাইরাল সংক্রমণের শিকার রোগীর দেহে।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারি এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা, সার্স এবং ’এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান’ এর মতো রোগের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হওয়ার পর বিশ্বে এ পর্যন্ত ৪৫ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে আর মারা গেছে তিনলক্ষের বেশি মানুষ। বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ২৯৮জন।
কিন্তু এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি কার্যকর কোন ওষুধ বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
প্লাজমা থেরাপি কী?
মানুষের রক্তের জলীয় অংশকে বলা হয় প্লাজমা বা রক্তরস। রক্তের মধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগই থাকে হলুদাভ রঙের এই প্লাজমা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে যারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের শরীরে এক ধরণের অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তৈরি হয়।
তাদের শরীর থেকে প্লাজমার মাধ্যমে সংগ্রহ করা এই অ্যান্টিবডি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করা হয়, তখন তার শরীরের সেই অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তখন তিনিও সুস্থ হয়ে ওঠেন।
চিকিৎসকরা এভাবেই করোনাজয়ী একজনের শরীর থেকে প্লাজমা বা রক্তরস সংগ্রহ করে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রয়োগ করবেন। ফলে তার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে।
ডা: এম এ খান বলছেন, ”প্লাজমায় অনেক ধরণের অ্যান্টিবডি থাকে। যখন কেউ কোন রোগে আক্রান্ত হন, তখন সেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বিরুদ্ধে এ ধরণের অ্যান্টিবডি প্রোটিন তৈরি হয়। ওই প্রোটিন জীবাণুর চারপাশে এক ধরনের আবরণ তৈরি করে সেটাকে অকেজো করে ফেলে। এভাবেই অ্যান্টিবডি কাজ করে।”
প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে একজনের শরীরের কার্যকর অ্যান্টিবডি অন্যদের শরীরের স্থানান্তর করা হবে।
কীভাবে দেয়া হবে প্লাজমা থেরাপি
চিকিৎসকরা আশা করছেন একজন সুস্থ রোগীর শরীর থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা দুই থেকে তিনজন অসুস্থ রোগীকে দেয়া সম্ভব হবে।
শনিবার তিনজন করোনাজয়ী চিকিৎসকের শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের শরীর থেকে সংগ্রহ করা প্লাজমা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি থাকা ৪৫ জনের শরীরে প্রয়োগ করা হবে।
ডা. এম এ খান বলছেন, “আপাতত কয়েকদিন আমরা শুধু প্লাজমা সংগ্রহ করবো। এসব প্লাজমায় কতটা অ্যান্টিবডি রয়েছে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সেটা একটা বিশেষ রিএজেন্ট ব্যবহার করে করতে হয়, সেগুলো স্পেন থেকে আনানো হয়েছে।”
“এরপরে কোন ধরণের রোগীকে সেই প্লাজমা দেয়া হবে, সেটা বাছাই করতে হবে। শুরুতে আমরা গুরুতর অসুস্থ বা মুমূর্ষু রোগীদের দিতে চাই, বিশেষ করে যাদের শ্বাসকষ্ট রয়েছে, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে।”
”এভাবে ৪৫ জন রোগীর শরীরে এই প্লাজমা প্রয়োগের পর আমরা কার্যকারিতা দেখবো। কতটা কাজ করছে, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, জ্বর কমলো কিনা, নিউমোনিয়ার কি অবস্থা ইত্যাদি। পাশাপাশি অপর ৪৫ রোগী বাছাই করে নিয়ে তাদের উন্নতির বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি দেখা যায়, প্লাজমা থেরাপিতে ভালো কাজ হচ্ছে, তখন এটা বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ করা শুরু হবে। ”
”এমন না যে, শতভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এটা কাজ করবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের তো কোন কার্যকর চিকিৎসার উপায় নেই। ফলে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে দেখতে অসুবিধা নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই প্লাজমা থেরাপির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। আইসিইউতে নেয়ার আগে এই থেরাপির প্রয়োগ করা গেলে ভালো ফলাফল আসতে পারে।”
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব, ভারত, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে সফলভাবে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ করা হয়েছে। সেখানে সাফল্যের হার বেশ ভালো। এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে।
”হাসপাতালে ভর্তির পর যেসব রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তাদের যদি এক ব্যাগ বা ২০০ মিলিমিটার পরিমাণ প্লাজমা দেয়া যায়, তাহলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। কারণ প্লাজমা শরীরের রক্তের মধ্যে যে ভাইরাস থাকে, তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।” তিনি বলছেন।
এই গবেষণার জন্য তাদের ছয় মাস সময় দেয়া হলেও, ডা. খান আশা করছেন, দু’মাসের মধ্যেই তারা তাদের পরীক্ষা শেষ করতে পারবেন। জুন মাসের শেষ নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরণের রোগীর ওপর এটি প্রয়োগ করা যাবে বলে তারা আশা করছেন।
গত এপ্রিল মাসে এই বিষয়ে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের স্থাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই কমিটির প্রধান করা হয় অধ্যাপক ডা. এম এ খানকে।
চীনে পরীক্ষায় সফলতার দাবি
চীনে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ার পর সেখানে প্রথম এটি নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়।
শেনঝেন পিপলস হাসপাতাল এনিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ২৭শে মার্চ। চীনের ‘ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ’ এই হাসপাতালেই। ৩৬ হতে ৭৩ বছর বয়সী পাঁচজন রোগীর ওপর এই পদ্ধতিতে চালানো চিকিৎসার ফল বর্ণনা করা হয়েছে এতে।
কোভিড-নাইনটিন থেকে পুরোপুরি সেরে উঠা পাঁচজনের রক্ত সঞ্চালিত করা হয় এই পাঁচ রোগীর দেহে। এদের সবাই ১২ দিন চিকিৎসার পর পুরোপুরি সেরে উঠেছেন বলে চীনা গবেষকরা দাবি করছেন।
এই পদ্ধতির সাফল্য ব্যাপক ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এখনো সম্পূর্ণ প্রমাণিত নয়। তারপরও এটির মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। কেবল গুরুতর অসুস্থ কোভিড-নাইনটিন রোগীদের জরুরী চিকিৎসায় ডাক্তাররা এই থেরাপি ব্যবহার করতে পারবেন বলে জানাচ্ছে লস এঞ্জেলস টাইমস। হিউস্টন মেথডিস্ট হাসপাতাল যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এই থেরাপি ব্যবহার করেছে।
প্লাজমা সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ
হেমাটোলজির অধ্যাপক এম এ খান বলছেন, ”প্লাজমা দানের ব্যাপারে এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। যারা প্লাজমা দেবেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। এখানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। বরং তার প্লাজমা হয়তো অন্যদের সুস্থ হয়ে উঠতে সহায়তা করবে। এটা একেবারে রক্ত দেয়ার মতো একটা ব্যাপার।”
কিন্তু প্লাজমা সংগ্রহ তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। কারণ এখনো সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের খুব একটা সাড়া পাচ্ছেন না তারা। এজন্য আপাতত চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্লাজমা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
”পুরোপুরি প্রয়োগের আগে আমাদের প্লাজমার একটা ব্যাংক তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে অনেককে থেরাপি দেয়া যায়। সেজন্য করোনাভাইরাস থেকে যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের এগিয়ে আসতে হবে।”
পুলিশ, বিভিন্ন বাহিনীসহ যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হয়েছে, প্লাজমা দেয়ার জন্য তাদের প্রতি তিনি আহবান জানিয়েছেন।
এছাড়া অ্যান্টিবডি পরীক্ষার রি-এজেন্ট ও কিট অনেক ব্যয়বহুল বলে তিনি জানান।
”সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং সরকারি সহযোগিতা ছাড়া প্লাজমা সংগ্রহের পুরো কাজটি সফল করা সম্ভব নয়।” তিনি বলছেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হয়েছেন, এমন যে কেউ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগে যোগাযোগ করে প্লাজমা দিতে পারবেন।