কক্সবাজার
খাদ্য উৎপাদন কমার আশংকা, বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিবেশ ও পরিবেশ
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজার জেলার বিভিন্নস্থানে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। চাষাবাদযোগ্য জমিগুলো ভরাট করে বসতবাড়ি কিংবা বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে।যার কারণে দিন দিন আবাদি জমির সংকট দেখা দিচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্নস্থানে ভরাট করা হচ্ছে জলাশয়। কাটা হচ্ছে গাছ-গাছালি ও পাহাড়। যার ফলে এলাকার প্রতিবেশ ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। সরকারিভাবে আবাদি জমি কিংবা জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও তা এই জেলায় মানা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিতে কোন সময়ই দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন এলাকার সচেতন মহল।
জানা গেছে, এ সংকট সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায়। এই দুই উপজেলায় সাড়ে ৪ লাখ লোকের বসতি হলেও যুক্ত হয়েছে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি ও পাহাড় ধ্বংস হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত নানা এনজিওগুলোর চাকরিজীবীদের জন্য বাসা বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়ে ভরাট হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি। জনসংখ্যার অতি চাপে এই দু’উপজেলায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, জেলায় প্রতি বছরে গড়ে এক হাজার হেক্টর কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। জেলায় বর্তমানে আবাদি জমির পরিমাণ ৮৫৫৭১ হেক্টর। যা বিগত ৪/৫ বছর আগে ছিল ৮৯ হাজার হেক্টর। সে হিসেবে প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমছে। এতে কৃষিপণ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি আশপাশের জমিগুলোতে চাষাবাদ কমে আসছে।
এছাড়াও জেলার বিভিন্ন জায়গায় নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, কৃষিপণ্যের দাম কমে যাওয়া, কৃষি কাজের উপকরণসহ সব কিছুর দাম বাড়তি এবং জমি সংক্রান্ত মামলার মোকাদ্দমার কারণেও কৃষি জমিতে আবাদ কমে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
উখিয়া উপজেলার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং এলাকার কৃষক অরবিন্দু বলেন, আমার বয়স ৮০ বছরের বেশি, আগে আমি অন্তত ১৪ থেকে ১৫ একর জমি চাষাবাদ করতাম। ৮/১০ বছর আগেও ৮/১০ একর জমি চাষাবাদ করেছি। কিন্তু এখন ২/৩ একরের বেশি করতে পারি না। মূলত আগে কিছু জমি বর্গা নিতাম। এখন সেসব জমির মালিক জমি ফেরত নিয়ে গেছে। এখানে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা চাকরিজীবীদের জন্য বাসা বাড়ি। জমির চাষাবাদের চেয়ে বাসা বাড়িতে আয় ভাল। তাই জমি মালিকরা সেদিকে ঝুঁকেছেন। আর আমার কাছে যা আছে তাও চাষ করিনা, কারণ বছর শেষে লোকসান থাকে। শ্রমিক খরচ, সার বীজ খরচ, যোগাযোগ, সব মিলিয়ে প্রতি একরে ধান যা পাই তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায়। আমরা ধান বিক্রি করতে গেলে এক আড়ি ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা নেয় কিন্তু মিল মালিকরা বিক্রি করে ৩৫০ টাকায়।
ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর এলাকার চাষি রুহুল আমিন বলেন, আমার নিজস্ব ১২ কানি জমি আছে, তার মধ্যে এখন ২ কানির মত রেললাইনে পড়েছে। সেই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ এবং দালালদের নিয়ে সিন্ডিকেট করে বিপুল টাকা নিয়ে ফেলেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে ২ কানি সরকার নিয়েছে কিন্তু কোন জমিতে চাষাবাদ করতে পারছিনা। কারণ সেখানে রেললাইনের মাটি ফেলে জমি নষ্ট করে ফেলেছে।
উখিয়া উপজেলা সদর রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, আমার উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর জমি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে লেগেছে। তার উপর এসব রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত চাকরিজীবীদের জন্য শত শত হেক্টর জমি নষ্ট হয়েছে বাসা-বাড়ি নির্মাণের ফলে। শত শত একর চাষাবাদযোগ্য জমি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কাটা হয়েছে গাছ-গাছালি ও পাহাড়। সব মিলিয়ে এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিদিনই চাষাবাদযোগ্য জমিগুলো বিনষ্ট করে গড়ে তোলা হচ্ছে নানা স্থাপনা। কারণ চাষাবাদের চেয়ে বাসা বাড়ি ভাড়া দিলে টাকা রোজগাড় হয় বেশি। তাই তারা এদিকে বেশি ঝুঁকছেন।
কক্সবাজার শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এসএম পাড়ার মোহম্মদ উল্লাহ বলেন, এখন কক্সবাজার শহরের জমির অনেক দাম। বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা শহরে জমি কিনতে চায়। বসবাস করতে চায় জেলা শহরে। বেশ কিছু চাষাবাদ যোগ্য জমি টাকার জন্য বিক্রি করে দিয়েছি। এখানে এখন গড়ে উঠেছে বড় বড় দালানকোঠা।
শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিজিবি ক্যাম্প এলাকার কৃষকলীগ নেতা আপ্লাতুন বলেন, কয়েক বছর আগে এখানে কোন খালি জমি দেখতাম না, সব জমিতে ধান বা শীতকালীন সবজি চাষাবাদ হতো। কিন্তু এখন রাস্তার দু’পাশের জমি বিক্রির কারণে গড়ে উঠেছে সব বসতবাড়ি। রাস্তার পাশে এখন চাষাবাদযোগ্য তেমন কোন জমি নেই বললেই চলে। এভাবে প্রতিবছরই চাষাবাদযোগ্য জমিগুলো ভরাট হচ্ছে। কমছে চাষাবাদ বাড়ছে স্থাপনা।
তবে সব আশংকাকে উড়িয়ে দিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. এখলাস উদ্দিন বলেন, কৃষি জমি কমছে সেটা একেবারে ঠিক নয়। ইদানিং অনেক নতুন নতুন অনাবাদি জমি আবাদ হচ্ছে। এখন বন বিভাগ এবং সরকারি খাস জমিতেও বেশ কিছু জমিতে কৃষি ফসল উৎপাদন হচ্ছে, আবার ফলন ও ভাল হচ্ছে। তবে একেবারে ক্ষতি হচ্ছে না তা বলা যাবে না। জলাশয়, পাহাড় ইত্যাদি বিনষ্টের ফলে চরম ক্ষতি হয়েছে।