সুপ্রভাত ডেস্ক »
কিছুদিন আগে সৌদি আরবের মসজিদগুলোতে মাইকের আওয়াজ কম রাখা সংক্রান্ত যে সরকারি নির্দেশনা জারি হয়েছে, তাতে বিস্মিত হয়েছেন অনেকেই। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, মাইকের ভলিউম বেশি থাকলে যে উচ্চমাত্রার শব্দ তৈরি হয়, তা দেশের শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য ক্ষতিকর।
ওয়াহাবি মতবাদ, যেটি ইসলামের সবচেয়ে কট্টরপন্থি মতবাদগুলোর অন্যতম, তার একনিষ্ঠ অনুসারী সৌদি আরবে এই নির্দেশ অভূতপূর্ব। এটিই বিশ্বের অনেকের কাছে বিস্ময়ের কারণ। তবে এক্ষেত্রে বলা যায়, মসজিদের মাইকের ভলিউম কম রাখার ঘোষণায় যারা বিস্মিত হয়েছেন, এটি কেবল তাদের জন্য বিস্ময়ের শুরু। আরও কিছু চমক নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে হাজির হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসলাম ধর্মের জন্মস্থান ও মূলকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই দেশটি।
মুসলিমদের পবিত্রতম মসজিদ কাবা শরিফ ও মসজিদুন্নবীর অবস্থান সৌদি আরবে। দেশটিতে লাখ লাখ মসজিদ আছে। সৌদি সরকারের সাম্প্রতিক সংস্কারের ঘোষণা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারেও ‘আমরা মসজিদে মাইকে আজানের ধ্বনি ফিরে পেতে চাই’ নামে একটি হ্যাশট্যাগও করেছেন প্রতিবাদকারীরা।
তবে শত প্রতিবাদের মধ্যেও অনড় অবস্থানে রয়েছে সৌদি প্রশাসন। সৌদি আরব বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, দেশটির বর্তমান প্রশাসন ধর্মীয় অনুশাসনের চেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
তাদেরই একজন যুক্তরাজ্যের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আজিজ আলঘাশিয়ান। ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব তার সার্বিক অর্থনৈতিক-সামাজিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে; এবং এই উদ্যোগের প্রধান কারণ— দেশটি সম্পর্কে বিনিয়োগকারী ও বাইরের দেশের ভ্রমণকারীদের যে নেতিবাচক ধারণা আছে, সেসব দূর করা।’
ওয়াহাবি পরবর্তী যুগে প্রবেশ
মসজিদের মাইকের শব্দের মাত্রা কম রাখার নির্দেশ দেওয়া ছাড়াও সম্প্রতি বেশকিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি সরকার, যা আগে চিন্তাও করা যেত না। কয়েক বছর আগেও দেশটিতে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে ছিল ধর্মীয় পুলিশ।
এক সময় এই বাহিনী ছিল সৌদি জনগণের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। বাহিনীর সদস্যরা সারাক্ষণ জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ঘুরে বেড়াতেন এবং অনেক সময় কোনও কারণ ছাড়াই মানুষজন এই বাহিনীর সদস্যদের হয়রানির শিকার হতেন। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের দিকে দু’বার তাকানোর অপরাধে ধর্মীয় পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন— এমন মানুষও দেশটিতে প্রচুর রয়েছেন।
কিন্তু মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে বর্তমানে এই বাহিনী প্রায় নিস্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া এখন সৌদি আরবে অনেক শপিং মল ও রেস্তোরাঁ দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে; যা আগে কল্পনাও করা যেত না। সে সময় নিয়ম ছিল- নামাজের সময় শপিং মল ও রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখতে হবে।
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এক সময় সৌদি আরবের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অমুসলিমদের অবজ্ঞা করে ‘শুকর’ বা ‘বনমানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। সরকারি নির্দেশে সেসব বাতিল করা হয়েছে।
সিনেমা হল স্থাপন এবং নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে সৌদি। এমনকি দেশটিতে বসবাসরত অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় স্থাপনেরও অনুমতি মিলেছে। যা অতীতে কল্পনাও করা অসম্ভব ছিল। আগে সৌদি আরবে ইসলাম ব্যতিত অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালন নিষিদ্ধ ছিল।
মদ্যপান ও বিক্রির বিষয়ে দেশটিতে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সরকারিভাবে তা এখনও তুলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকারি প্রশাসনের উচ্চ-পর্যায়ের এক কর্মকর্তা এএফপিকে জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে এই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের আরব গালফ স্টেট ইনস্টিটিউটের গবেষক ক্রিস্টিন ডিওয়ান বলেন, ‘যদিও দেশটিতে কট্টরপন্থী ধর্মীয় আবহ এখনও প্রবহমান; কিন্তু তারপরও এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে ওয়াহাবি মতবাদ থেকে সরে আসছে।’
‘বর্তমান সৌদি সরকার মানুষকে বোঝাতে চাইছে, এখন থেকে অর্থনীতি, সামাজিক জীবন ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ধর্ম আর খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়।’
প্রতিপক্ষ নির্মূল
সৌদি আরবের যে সাম্প্রতিক সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার, তার প্রধান সূত্র-সঞ্চালক হিসেবে কাজ করছেন দেশটির ডি-ফ্যাক্টো নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান; আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যিনি এমবিএস নামে পরিচিত। দেশে উদারতাবাদী সংস্কারের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে যেমন তার সুনাম আছে, তেমনই সমালোচনা আছে প্রতিপক্ষের বিষয়ে তার ক্ষমাহীন মনোভাবের জন্য।
সৌদি রাজপরিবারের অন্যতম প্রধান সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সৌদি আরবে নিয়োজিত এক কূটনীতিক বলেন, ‘তার (মোহাম্মদ বিন সালমান) মনোভাব বেশ পরিষ্কার। সেটি হলো– আমরা কাশ্মির বা উইঘুর নিয়ে কোনো কথা বলব না, তোমরাও খাসোগির মৃত্যু নিয়ে কোনো কথা বলবে না।’
ক্ষমতায় আসার পর মোহাম্মদ বিন সালমান তার চাচাতো ভাই ও সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে গৃহবন্দি করেন। তার প্রধান সহযোগী ছিলেন সুলাইমান আল দাওয়ায়িশ। ২০১৬ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে এক টুইটে বাদশাহ সালমান ও তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘একজন পিতা তার সন্তানকে নিজের হাতে নষ্ট করেছেন।’
এই টুইটকে ভালোভাবে নেননি এমবিএস। ফলে ২০১৬ সালের পর থেকে আর দেখা যায়নি সুলাইমান আল দাওয়ায়িশকে। তিনি কোথায়, কেমন আছেন— তা এখনো অজানা।
এ রকম আরেকজনের নাম সালমান আল আওদা। ২০১৭ সালে সৌদি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এই কর্মকর্তা কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত বলে একটি টুইট করেছিলেন। ওই টুইটের পরই কারাবন্দি করা হয় তাকে। তারপর ২০২১ সালে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে সৌদির। কিন্তু এখনো তিনি আছেন কারাগারে।
ক্রিস্টিন ডিওয়ান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে নিজের অবস্থান নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত রাখার জন্য সব প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এমনকি এক্ষেত্রে যারা একটি আধুনিক সৌদি আরব কামনা করেন, তাদেরকেও ছাড় দেওয়ার পক্ষপাতি নন তিনি।’
সূত্র : এএফপি/ঢাকা পোস্ট