সঞ্জয় দাশ »
ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে বেজেই চলেছে। রোহিত শাওয়ার নিচ্ছেন প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে। গা-মোছার পর্ব শেষ করে বের হতেই ফের বাজতে শুরু করলো ফোনটা। ওপ্রান্ত থেকে ‘কিরে তোমার কী হলো? থাকো কোথায় তুমি ?
ওয়েলস এর ফোন দেখে তড়িৎ গতিতে রিসিভ বাটনে চাপ দিতেই ঝাঁজালো স্বরের আওয়াজটা কানে যেতেই তড়িঘড়ি করে খেই হারিয়ে ফেলা রোহিতের একটাই উত্তর ‘কেমন আছ?’
এইতো। শোনো তোমাকে যে জন্য ফোন করলাম; আমার দেশে আসা হচ্ছে না।
মাথায় যেন বাজ পড়লো। বলে কী এই মেয়ে! ও দেশে আসার খবর পেয়ে কত আয়োজনই না সে সাজিয়ে রেখেছিলো। এটা কী খবর শোনাল ওয়েলস!
তুমি আসছো না মানে?
হুম এখানে আমার স্বামীর কিছু কাজ পড়ে গেছে। তোমাকে পরে বলবো।
তাহলে এই হলো তোমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত।
কী করবো বলো। আসলে আমার কিছুই করার ছিলো না। ও হঠাৎ করে এতগুলো কাজ কীভাবে সাজিয়ে রাখলো; ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সরি।
ঠিক আছে। তবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
কেন?
এই যে তোমার আসার খবরে কত কী আয়োজন গুছিয়ে এনেছিলাম।
ওহ্ , দেখি কী করা যায়। আমি চেষ্টা করবো।
নানান কথা শেষে তাদের কথা সেদিনের মতো শেষ হয়ে গেলেও বিষয়টাকে হাল্কাভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না রোহিত। কী এমন কারণ থাকতে পারে যে ওয়েলস দেশে আসতে পারছে না। তার যুক্তিগুলো বিশ্বাস করলেও সহজে মানতে পারছিলেন না রোহিত।
অসম অবস্থান অশান্তি তৈরি করে। সাম্যতার ভিত্তিতে যে সম্পর্ক তাতে সর্বজনীনতা আসে। সেই সাম্যতার ভিত্তি যখন তিরোহিত তখন প্রান্তিক সময়ে হতবিহ্বলতাও দানা বাঁধতে থাকে। নিরালম্ব সময় খুবলে খায় বাসনা। অতীতচারী ভাবালুতাও লোপ পেতে থাকে। আর এ অবস্থায় কী করণীয় তা নির্ধারণ করাও বেশ জটিল। সম্পর্কের চোরাবালিতে হাবুডবু খেতে থাকা রোহিতের অনুভবগুলো তাকেই যেন ভেঙচি মারতে থাকে অবিরত। সময়ের জটিল মেরুকরণে পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টে তার যাপিত জীবনটাও হয়ে যায় হতচ্ছাড়া টাইপের।
দীর্ঘদিন পর হঠাৎ প্রচণ্ড অসুখে কাবু হয়ে পড়লেন রোহিত। রাত বাড়তে থাকলে অসুখের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় তার সাহচার্য প্রয়োজন। অথচ দিব্যি অবলীলায় শুন্য ঘরে শুন্যতা তাকে ভেংচি মারে। নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হয় কখনো-সখনো। মাঝে মাঝে কথা বলার সুতীব্র বাসনা জাগলেও সেসব ভাবনায় ফেলে রাখা বটির মতো মরচে ধরে যায়। এ কোন যাপিত জীবন তার!
নর্থ কেরোলিনা অঙ্গরাজ্যে গত ডিসেম্বরে বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষে ঘুরতে গিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে ওয়েলসের। ওখান থেকে ঘুরে আসার পর জমকালে একটা ছবি ফেসবুক প্রোফাইলে সেটে দিয়েছে সে। যদিও তার এ ছবি মনের মতো হয়নি। অবশ্য তার মনের মতো না হলেও ওয়েলসের তাতে কিছু যায় আসে না। সেই কবে তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে রোহিত। সম্ভবত পাঁচ মাস আগে। তাকে একসেপ্টও করেনি ওয়েলস। কী কারণ থাকতে পারে; ঠিক বুঝে উঠতে পারে না রোহিত।
ছাইপাশ ভাবতে থাকা রোহিতের এক পর্যায়ে ঘুম চলে আসে।
এখনকার প্রজন্মরা কেমন যেন?
মানে বুঝলাম না।
দ্যাখো বর্তমান যেসব প্রজন্ম তারা তো আমাদেরই উত্তরসূরি; তাইনা। ওদের চিন্তাগুলো কেমন আত্মকেন্দ্রিক।
হুম , বলতে পারো এটা এক ধরনের সমাজবাস্তবতা।
সে যাই হোক আমি আমার বাচ্চাদের ন্যূনতম সৌজন্যতাবোধের বিষয়ে তালিম দিয়েছি।
খুব ভালো, তুমি তো তুমিই।
ঢং করো না।
সত্যি বলছি। তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
হয়েছে আর বলতে হবে না।
যা সত্যি তাই বললাম। আমি কিন্তু বাড়িয়ে কিছু বলি না।
আচ্ছা একটা দাতব্য সংস্থা নিয়ে কাজ করছিলে। তার কাজ কতদূর এগুলো?
এইতো চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। কিছু ফান্ড প্রয়োজন।
ওহ্ । ওসব কোনো সমস্যা নয় তোমার জন্য। দেখো তুমি ঠিকই চালিয়ে নিতে পারবে।
তাই যেন হয়। এটা নিয়ে আরো অনেক স্বপ্ন রয়েছে আমার।
আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেলো খুব ভোরে। তাহলে এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলেন রোহিত! স্বপ্ন…..সব কেবলি স্বপ্ন….. এতক্ষণ কি সব স্বপ্নই না দেখলো সে। রোহিত কি সারাজীবন এভাবে শুধু স্বপ্নই দেখতে থাকবে। নিজেকেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর তৈরি করতে বসে সে। এদিকে পুরো বাসাটাই অগোছালো হয়ে পড়েছে। কাজের বুয়াও আসছে না এক সপ্তাহ ধরে। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা সাফ করে ব্রাশ করতে লাগলো সে। এর আগে চুলায় গরম পানির কেটলিতে কিছু চা’পাতা দিয়ে এসেছে সে। মাঝে মধ্যে চরম বিরক্তি চলে আসে। এমন বৈরাগ্য জীবনও হয় মানুষের। না আছে শারীরিক সুখভোগ, না আছে মনের……তাহলে কী আছে রোহিতের!
আয়নায় নিজের বিদঘুটে চেহারা দেখে নিজেই চমকে যায় সে। নিজের এমন কুৎসিত দর্শন চেহারার দিকে তাকিয়ে একদলা থুতু ছিটাতে ইচ্ছে হলো। নির্দয় শীতে এমন অদ্ভুদ বিকারের মানে কী ঠিক ঠাহর করতে পারে না সে। হঠাৎ জেগে ওঠা এমন ইচ্ছের অনেক কারণও রয়েছে বৈকি। সঙ্গ-বঞ্চিত বধিরতা তাকে খুবলে ধরেছে। ব্রাশ করা শেষে টেবিলে নাস্তা পর্ব সেরে গাড়ি নিয়ে ছুটলো দেয়াংপাহাড়। পথে যেতে যেতে নানা পরিবর্তন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো। কিন্তু মানুষের অভাব তো ঠিকই আছে। চারদিকের রাস্তাঘাট বেশ সম্প্রসারিত হলেও অর্থনৈতিক দৈন্য জিইয়ে রয়েছে। ক্রুর সময়ে এসে খাবি খাচ্ছে মানুষ। ছাইপাশ চিন্তা করতে করতে খানিক আনমনে হয়ে যাওয়া রোহিত গাড়ি নিয়ে ফাজিলখাঁর হাটের বাজারের পাশে কখন পৌঁছালো নিজেই বুঝতে পারে না। এখানেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে রাস্তাঘাটের। দেয়াং পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাটা এখনও তার বেশ মনে আছে। দুপুুর গড়িয়ে এলো। লাতু মাঝির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো কেউ তাকে অবলোকন করছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ফুঁকছিলো সে। বিলের মাঝপথ ধরেই এগুচ্ছে সে। একটা খাড়া পাহাড় ডিঙাতে গিয়েই মনে হলো এবার একটু জিরিয়ে নেয়া দরকার। এ ভর দুপুরে ধান গাছের ডগায় জড়িয়ে আছে শিশিরবিন্দু। সরীসৃপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে যাওয়া কিছু লতা একটা মেহগিনি গাছের গোড়ালি থেকে উঠে গেছে মগডালে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে এয়ারফোন বের করে হঠাৎ গান শুনতে শুরু করলো রোহিত। খানিকবাদে ফের হাঁটতে শুরু করলো সে। কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো একটা ঝিল। আজ থেকে ১৫ বছর আগে ঠিক এ জায়গায় এসে এভাবে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে গান শুনেছিলো সে। প্রচ্ছন্ন অতীতের মায়াজাল তাকে খুবলে খেতে থাকে। খুব ইচ্ছে করে ওয়েলসকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করতে ‘তুমি কী খুব ভালো আছো ওয়েলস? জানো আমি ভালো নেই। নিঃসঙ্গতা আমাকে ভেংচি কাটে। তুমি বিহীন এ পৃথিবী অসাঢ়’। নিজের আজীব ছেলেমানুষী যেন তাকেই ব্যঙ্গ করছে। গত কয়েক মাস আগে দেশের এক নামকরা কবি মারা গেলেন। অকৃতদার এ কবি জীবনভর ভালোবেসেছিলেন এক নারীকে। তার লেখা সারা কবিতাজুড়েই রয়েছে ওই নারীর স্মৃতিদহন! রোহিতেরও কি ওই কবির মতো অবস্থা?
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে কুয়াশার কুণ্ডলী পাকিয়ে। একটা অশ্বথ গাছের নীচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রোহিতের হঠাৎ মনে হতে লাগলো ফোনটায় ভাইব্রেশন হচ্ছে। আমেরিকার এ কাকডাকা ভোরে ওয়েলস এর ফোন দেখে তার চোখ চড়কগাছ।
কী অবস্থা তোমার?
এত ভোরে কী মনে করে?
তোমাদের ওখানে সন্ধ্যা, আমাদের ভোর। তুমি তো আমি ফোন না করলে ফোন কর না?
কথাগুলো কি ওয়েলস বলছে…..বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই রোহিতকে ফের অবাক করে দিয়ে ওয়েলস বললো-
সামনে মাসে একটা দেশে ট্যুরে যাবো। তুমি যদি যেতে চাও চলে আসতে পারো।
রোহিতের মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। একটা ঘোরলাগা আবেশ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেয়াং পাহাড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় গিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলো সে। পৃথিবীটা মুহূর্তের মধ্যেই তাকে নিয়ে গেলো এক অন্যরকম মুগ্ধতায়। তার কেবলি মনে হতে লাগলো পৃথিবীতে সে একা নয় …..তার পাশে ওয়েলস নামে এক মহীয়সী নারীও আছে; যাকে নিয়ে মুগ্ধতায় ভেসে থাকা যায়। (চলবে)