সুপ্রভাত ডেস্ক »
পদ্মা সেতু একটি স্বপ্নের সেতু। যা কেবল বাংলাদেশের রাজধানী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে না বরং এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সংযোগ ও বাণিজ্যেও অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ে-১ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেও কাজ করবে, যা এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা এবং উপমহাদেশে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করবে।
বাংলাদেশ ২০০৯ সালের আগস্টে ৩২টি দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া ১ লাখ ৪৫ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সড়ক মহাসড়কের মাধ্যমে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে জাতিসংঘকর্তৃক পরিকল্পিত এই নেটওয়ার্কে যোগ দেয়।
বাংলাদেশ এএইচ-১, এএইচ-২ ও এএইচ-৪১ নামে ৩টি এশীয় মহাসড়ক রুটের সঙ্গে যুক্ত, যার মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭৭১ কিলোমিটার।
এএইচ-১, সিলেট-ঢাকা-নড়াইল-যশোর হয়ে আসামকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এর দুটি জায়গায় সংযোগ অনুপস্থিত ছিল। তাদের একটি পদ্মা সেতু অপরটি নড়াইলের কালনা সেতু।
এই দুটি সেতুর মধ্যে কালনায় ৬৯০ মিটার সেতু নির্মাণ তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। তবে পদ্মা নদীর উপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুটি কাজের পরিমাপের দিক থেকে নির্মাণ করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।
আজ পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে কালনা সেতু উদ্বোধনের সম্ভাবনা আছে। ফলে এএইচ-১ সংযোগে যে সমস্যা ছিল তা দূর হবে।
বাংলাদেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে (টিএআর) নেটওয়ার্কের জন্য একটি নতুন রুট স্থাপনের পথও প্রশস্ত করবে। যা এশিয়া জুড়ে একটি সমন্বিত রেল নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্যে জাতিসংঘের আরেকটি উদ্যোগ।
এটি হবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া চতুর্থ এবং সংক্ষিপ্ততম টিএআর রুট, যা বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারকে সংযুক্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত ২৮টি দেশকে সেবা প্রদানকারী ১ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রেলপথ নিয়ে গঠিত নেটওয়ার্কের একটি অংশ হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখার পাশাপাশি, পদ্মা সেতু কুয়াকাটাকে একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করতে সহায়তা করবে।
পদ্মা সেতু মংলা বন্দর এবং নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দরের সর্বাধিক ব্যবহারে সহায়তা করবে। ফলে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার কারণে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে সেবা দেওয়ার জন্য সংগ্রামরত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমবে।
এএইচ-১ ও পদ্মা সেতু
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইউএনইএসসিএপি) এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং ২০০৩ সালের নভেম্বরে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের উপর সদস্য রাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের নথি অনুযায়ী, সড়ক নেটওয়ার্কের উপর ভিত্তি করে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করাই এই নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০০৯ সালের ১৫ জুন এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। একই বছরের ৫ জুলাই সরকার ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাসেসন স্বাক্ষর করে।
এএইচ-১ এর রুট হল আসামের গুয়াহাটি-তামাবিল-সিলেট-শায়েস্তাগঞ্জ-নরসিংদী-কাঁচপুর-ঢাকা-মাওয়া-চরজানাজত-ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া-কালনা ফেরি ঘাট-নড়াইল-যশোর-বেনাপোল এবং পশ্চিম বঙ্গের পেট্রাপোল। এর দৈর্ঘ্য ৪৯২ কিলোমিটার।
এএইচ-২ এর রুট হল গুয়াহাটি-তামাবিল-সিলেট-নরসিংদী-ঢাকা দক্ষিণ (যাত্রাবাড়ী)-ঢাকা উত্তর (বনানী রেল ক্রসিং)-জয়দেবপুর-এলেঙ্গা-হাতিকামরুল-বগুড়া-রংপুর-পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা এবং পশ্চিমবঙ্গের ফুলবাড়ি। এএইচ-১ এবং এএইচ-২ এর উভয় রুটে আছে এমন ২৯৪ কিলোমিটার অংশ বাদ দিলে এএইচ এর দৈর্ঘ্য হবে ৫১৭ কিলোমিটার।
এএইচ-৪১ রুটটি হলো টেকনাফ-কক্সবাজার-ফেনী-ময়নামতি-ঢাকা-জয়দেবপুর-হাতিকামরুল-বনপাড়া-দাসুরিয়া-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা-মংলা। এটি আপাতত দেশের মধ্যে সীমিত। তবে এএইচ-২ এবং এএইচ-৪১ এর উভয় রুটে আছে এমন ১৬২ কিলোমিটার অংশ বাদ দিলে এএইচ-৪১ এর দৈর্ঘ্য হবে ৭৬২ কিলোমিটার।
সড়ক ও জনপথ অধদপ্তরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শিশির কান্তি রাউত বলেন, ‘পদ্মা সেতু এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে কালনা সেতু উদ্বোধনের ফলে এএইচ-১ এর আর কোনো সংযোগ সড়ক বাদ থাকবে না। ফলে এএইচ -১ রুটে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। যা একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন।’
এএইচ-১ রুটের বেশিরভাগ অংশই ২-লেনের এবং এটি শহর এলাকা এবং বিভিন্ন বাজারের জায়গাগুলোতে ৪-লেন।
কাঁচপুর-সিলেট এবং সিলেট-তামাবিল অংশকে চার লেনে উন্নীত করতে সওজ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ধীর গতির যানবাহনের জন্য দুটি অতিরিক্ত লেন রাখা হবে।
এ বছর প্রকল্প ২টির ভৌত কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই রুটের মধ্যে কাঁচপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত অংশটি ৮ লেনের মহাসড়ক এবং ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৪ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে।
ভারতীয় ঋণের সহায়তায় ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার রাস্তাকে কালনা, নড়াইল ও যশোর হয়ে ৪ লেনের মহাসড়কে পরিণত করার প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সওজ।
এদিকে, কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদীর উপরে ৯৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৯০ মিটার সেতু তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে সহজ।
আঞ্চলিক সংযোগ সম্পর্কিত আরএইচডিরর থিম্যাটিক গ্রুপের সদস্য শিশির কান্তি বলেন, একবার সমস্ত প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে, পুরো এএইচ -১ রুটটি প্রাথমিক (প্রবেশাধিকার-নিয়ন্ত্রিত মহাসড়ক) বা ক্লাস-১ (চার বা ততোধিক লেনের মহাসড়ক) এ উন্নীত করা হবে।’
নতুন টিএআর রুট
ইউএনইএসকেএপির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, টিএআর নেটওয়ার্কের লক্ষ্য হলো এশিয়ায় রেলওয়ে অবকাঠামোর দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন করা।
২০০৬ সালের এপ্রিলে টিএআর নেটওয়ার্কের উপর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করা পর এই চুক্তি ২০০৯ সালের জুন মাসে কার্যকর হয়।
শুরুতে টিএআরের ৩টি রুট বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
টিএআর-১ এর রুটটি পশ্চিমবঙ্গের গেদে-দর্শনা-ঈশ্বরদী-বঙ্গবন্ধু সেতু-জয়দেবপুর-টঙ্গী-আখাউড়া-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঘুন্ধুম-মিয়ানমার।
এর দুটি উপ-রুট রয়েছে-টঙ্গী-ঢাকা এবং আখাউড়া-কুলাউড়া-শাহবাজপুর হয়ে ভারতের মহিষাসন।
টিএআর-২ এর রুটটি পশ্চিমবঙ্গের সিংগাবাদ-রোহনপুর-আব্দুলপুর-ঈশ্বরদীর মধ্য দিয়ে টিএআর-১ এর সঙ্গে মিলিত হয়।
টিএআর-৩-এর রুটটি পশ্চিমবঙ্গের রাধিকাপুর থেকে বিরল-দিনাজপুর-পার্বতীপুর-আব্দুলপুরের মধ্য দিয়ে টিএআর-১ এর সঙ্গে মিলিত হয়।
পদ্মা নদীর উপর দিয়ে একটি ডাবল ডেকার সেতু নির্মাণ যার উপরের মহাসড়ক এবং নীচে রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেল সংযোগের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে রাজধানী ও যশোরকে ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত করতে ইতোমধ্যে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প (পিবিআরএলপি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বাংলাদেশে রেলওয়ের অনুরোধে ইউএনইএসসিএপি বাংলাদেশে টিএআর নেটওয়ার্কের চতুর্থ রুট হিসেবে ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর রুটটি অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়।
টিএআর-১ এর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে পেট্রাপোল-বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাঙ্গা-মাওয়া-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-টঙ্গী পর্যন্ত রুটটি বিস্তৃত হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের জন্য একটি নতুন রুট চালু করেছে, যার মাধ্যমে রেলপথটি একটি বড় নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে।
সম্প্রতি তিনি দ্য এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য একটি নতুন পথ খুলবে।’
তবে, বাংলাদেশ রেলওয়েকে টিএআরের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের জন্য গেজ রূপান্তর সহ অনেক কিছু করতে হবে, তিনি যোগ করেন।
সূত্র : ডেইলি স্টার