এডিস মশার লার্ভায় বিপাকে রাঙামাটি

ফজলে এলাহী, রাঙামাটি

হঠাৎ করেই যেনো এডিস মশার চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে পার্বত্য শহর রাঙামাটি। সম্প্রতি জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি জরিপে শহরের ২২ শতাংশ ঘরেই এডিসের লার্ভা পাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে শহরে। অথচ কয়েক বছর আগেও পাহাড়ে আতংকের নাম ছিলো ম্যালেরিয়া,আলোচনাতেই ছিলোনা ডেঙ্গু। কিন্তু এই বছর হঠাৎ করেই দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু।

রাঙামাটি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. শওকত আকবর বলছেন,‘ আগের বছরগুলোতে এই জেলায় ডেঙ্গু রোগীর তথ্য খুব একটা শোনা না গেলেও এই বছর ইতোমধ্যেই ১৭ আগস্ট পর্যন্ত রাঙামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২০ জন রোগী, যাদের মধ্যে কারো কারো অবস্থা নাজুক হওয়ায় চট্টগ্রামেও রেফার করা হয়েছিলো,এই মুহূর্তে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১০ জন। তবে আশা কথা হলো, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুর কোন ঘটনা ঘটেনি।’

এ চিকিৎসক বলছেন, শুধু রাঙামাটিতেই নয়, সারাদেশেই ডেঙ্গু এবার বেশ ভোগাচ্ছে। শুরুর দিকে আমরা যেসব রোগী পাচ্ছিলাম, তারা প্রায় সবাই ছিলো ঢাকা থেকে আসা। পরে আমাদের সিভিল সার্জন অফিসের একটি জরিপের তথ্যে দেখছি, রাঙামাটি শহরেরই প্রায় ২২ শতাংশ ঘরেই যে এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু হয়, তার লার্ভা মিলেছে। বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগের।’

রাঙামাটির জেলা কীটতত্ত্ববিদ বিশ^জিৎ চৌধুরী বলছেন, সাধারণত আমরা দশ শতাংশের উপরে গেলেই সেটাকে বিপজ্জনক বলি, রাঙামাটিতে আমাদের জরিপে ২২ শতাংশ বসতঘরে এডিসের লার্ভা মিলেছে। বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক। এজন্য মশক নিধন কার্যক্রম জোরালো করার পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন হতে হবে। যেসব স্থানে জমানো পানি থাকে,তা যেনো কোনভাবেই মশার আবাসস্থল হতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই শহরে মাইকিংসহ প্রচারনা কার্যক্রম শুরু করেছি,মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’ ‘অন্যান্য বছর খুব সামান্য পরিমাণে ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর মিললেও এইবারের মত রাঙামাটিতে এত খারাপ পরিস্থিতি হয়নি গত কয়েক বছরেও।’
তিনি বলছেন, জেলা সিভিল সার্জন অফিসের উদ্যোগে জুলাই মাসে শহরের ১৫০ টি বসত থেকে সেম্পল নিয়ে জরিপটি করে ২২ শতাংশ বসতঘরেই এডিসের লার্ভা পেয়েছি। এরমধ্যে সবচে বেশি কল্যাণপুর, চম্পকনগর,পাথরঘাটা, পুরাতন বাস স্টেশন এবং তবলছড়ির মসজিদ কলোনি, ওয়াপদা কলোনি এলাকায় এই এলাকাগুলো সবচে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

এদিকে শহরে এডিস লার্ভার ব্যাপক বিস্তারে উদ্বিগ্ন শহরবাসীও। এনিয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো বেশি দায়িত্বশীল থাকা উচিত ছিলো বলে মনে করছেন তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক জিসান বখতেয়ার বলছেন, যদি লার্ভা ধ্বংসে নিয়মিত স্প্রে করা হতো তাহলে হয়ত এভাবে ডেঙ্গু ছড়াতো না। এখন শহরজুড়ে দ্রুত স্প্রে করা উচিত। নতুন করে যেনো কেউ আক্রান্ত না হয় সেই বিষয়ে পৌরসভা-জেলা পরিষদ-স্বাস্থ্যবিভাগসহ সবাই মিলে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’

তবে শহরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে কথা বলে, পৌরসভার মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে পাওয়া গেলো ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য। কেউ বলছেন, তাদের এলাকায় এখন পর্যন্ত একবারও স্প্রে করা হয়নি আবার কেউ বলছেন,তাদের এলাকায় স্প্রে করা হয়েছে।
রিজার্ভবাজার এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম বলছেন,এখন শেষ মুহূর্তে বিপদ বাড়ার পর স্প্রে করে লাভ কি ? পৌরসভা কেনো এতদিন অপেক্ষা করলো ? তারা তাদের রুটিন ওয়ার্ক হিসেবেই তো মশক নিধন কার্যক্রম চালানোর কথা। ঠিক সময়ে স্প্রে করার কথা। তারা এটা করেনি,তার দায় কেনো আমরা নিবো।’
বনরূপার অসীম চাকমা বলছেন, আমি বলার পর পৌরসভার টিম এসে আমাদের এলাকায় স্প্রে করে গেছে। এরপর এলাকার মানুষ কিছুটা ভালো আছে। কিন্তু পুরো শহরে স্প্রে করা না হলে আমাদের তো পৃথকভাবে ভালো থাকার সুযোগ নেই, কারণ এটা সামগ্রিক কাজ।’
রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলছেন,‘ শুরুতে আসলে আমরাও বুঝতে পারিনি, বা আমাদের কেউ বলেনি যে,এত ভয়ংকরভাবে দ্রুত এডিস মশা বংশবিস্তার করছে। পরে স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে জানার পরপরই আমরা যখনই যা করার, তা করছি। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্প্রে করছি, জরিপে যেসব এলাকাগুলোকে বেশি ঝুকিপূর্ণ বলা হয়েছে, সেসব স্থানে স্প্রে করাচ্ছি। পুরো শহরেই স্প্রে কার্যক্রম চলমান আছে। বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এই সংক্রান্ত জরুরি এক সভায় যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেসব বাস্তবায়ন শুরু করেছি। আসলে এখানে মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই মানুষকে সচেতন করার কার্যক্রম এবং এডিস’র লার্ভা ধ্বংসে স্প্রে কার্যক্রমও চলমান থাকবে। রাঙামাটি সদর হাসপাতালে যেনো ফ্রিতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়, সেজন্য আমি উদ্যোগ নিচ্ছি। পুরো শহরে স্প্রে না দিয়ে আমরা এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতেই দিচ্ছি,পুরো শহরে দিতে ২০/২৫ দিন সময় লাগবে।’