ড. মো. মোরশেদুল আলম »
বাংলাদেশের স্বাধীনতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিজেদের পরাজয়ের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত, তখন সদ্য স্বাধীন হতে যাওয়া দেশটিকে মেধাশূন্য করার জন্য বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের এদেশীয় দোসরদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ১৪ ডিসেম্বরের নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। প্রকাশ্যে দিবালোকে তাদের পরিকল্পিত এই ঘৃণ্য অপারেশন পরিচালিত হয়। যার বলি হন এদেশের অমিত সম্ভাবনাময়ী ভবিষ্যৎ আলোকদিশারি বহু বাঙালি সূর্যসন্তান। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত রূপ প্রকটিত হয় ডিসেম্বরের দ্বিতীয় দশকে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবী ও সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় সর্বাত্মক গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের টার্গেট হত্যা শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকা পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে দ্বিতীয় বিশযুদ্ধকালে হিটলারের ইহুদি নিধনের সাথে তুলনা করে বলে যে, ফ্যাসিস্ট সরকার যখন কোনো দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে চায়, তখন পরিকল্পিতভাবে সেই দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে বেছে বেছে হত্যা করে। পত্রিকাটির প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ওই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা ও রাজশাহীসহ বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষককে হত্যা করে, যাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরাও আছেন। প্রথম থেকেই গণহত্যার পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরা টার্গেট করে বুদ্ধিজীবী নিধনে নামে এবং সেটা শেষাবধি চলে।দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘কোন ভাষায় প্রকাশ করব আলবদর পশুদের এই নৃশংসতা’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘দৈনিক বাংলা গভীর বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, আলবদর ও আলশামস বাহিনী হিংস্র শ^াপদের নখর বিস্তার করে সংঘবদ্ধভাবে গত কয়েক দিনে দেশের বহুসংখ্যক গুণী সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক-এ ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবীসহ শতাধিক সোনার দুলাল নিহত’ শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়, ‘ফেরাউন আমল হইতে হিটলারের গ্যাস চেম্বার পর্যন্ত বহু অমানুষিক ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু সোনার বাংলার এই সোনার সন্তানদের হত্যাকাণ্ড বিশে^ সকল জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডকে মøান করিয়া দিয়াছে।…বাংলাদেশ হইতে বুদ্ধিজীবী নির্মূল অভিযানের নির্মম শিকারে পতিত সোনার দুলালদের ক্ষতবিক্ষত ও পূতিগন্ধময়, বিকৃত মৃতদেহগুলো রায়েরবাজারের পাশর্^বর্তী খানাখন্দক, নালা-ডোবা, ইটের গাদা ও গর্তে, কোথাও অনাবৃত এবং কোথাও সামান্য মাটি চাপা দেওয়া অবস্থায় ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।’
পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোয় বঞ্চনা ও নিপীড়নের প্রতিবাদে বাঙালির অসিশক্তিকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলে বুদ্ধিজীবী মহলের মসিশক্তি ও অনুপ্রেরণার বাণী। লেখনী হাতে বাণীর বাণ সঞ্চালনের দায়িত্বে ছিলেন বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী ও কলাকুশলীসহ অধিকার সচেতন বুদ্ধিজীবীরা। ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা তো ছিলেনই, তার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে আস্থাশীল বুদ্ধিজীবীবৃন্দও ছিলেন; যাঁরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বিশ^াসী ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি শ্রেণি-শোষণমুক্ত একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীনতাকামী একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রয়োজন পড়ে প্রগতিশীল মহলের দিকনির্দেশনা। তার ভিত্তিতেই রাজনৈতিক উদ্যোগ তৈরি হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অগ্রণী শিক্ষকমণ্ডলীসহ বাঙালি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ সেই দায়িত্ব সূচারুভাবে পালন করেন।
১৬ ডিসেম্বরের পর গভর্নর হাউস থেকে পাওয়া দলিলপত্রের মধ্যে ছিল রাও ফরমান আলীর অফিস ডায়েরি; যেখানে বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা ছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সেই তালিকাভুক্ত অনেক শিক্ষককে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ রাও ফরমান আলী এক স্বীকারোক্তিতে বলেন, মেজর জামশেদ বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির গ্রেফতার করার আদেশ পেয়েছেন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূত হার্বার্ট ডি স্পিভাক ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় জানান, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জামায়াতি দুর্বৃত্তরা জড়িত ছিল। নিহত বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও এটা নিশ্চিত যে, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনে পাকিস্তানি নোবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন ছিল। মার্কিন দলিলপত্র ছাড়াও পাশ্চাত্যের গবেষকরাও নিশ্চিত করেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন আল বদর আহিনী। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছামাদ তালুকদার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের নিকট দেওয়া সাক্ষ্যে জানান যে, চৌধুরী মঈনউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের আটক করে চোখ বেঁধে প্রথমে আল বদর হেডকোয়ার্টারে অমানবিক নির্যাতনের পর রায়েরবাজার এবং মিরপুরের শিয়ালবাড়ী ও হরিরামপুর গোরস্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকেই আলবদর বাহিনী রাও ফরমান আলীর নির্দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চালাতে থাকে। এ সময় থেকে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরিসহ বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁদের অপহরণ করে। হত্যাকাণ্ডের আগে আল বদর সদস্যরা টার্গেটকৃত বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে অনেক সময় সতর্কীকরণের যে চিঠি পাঠাত তা ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন পত্রিকায় ‘শনির চিঠি’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় বলা হয়: বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিক নির্দেশনাকারী পণ্ডিতরাই বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনমত, রাজনীতি ও মুল্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের তাত্ত্বিক ও যুগোপযোগী ইতিহাসভিত্তিক যৌক্তিকতা তুলে ধরার কাজটি করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ^াসী বুদ্ধিজীবী মহল এবং তাঁরাই জাতির ক্রান্তিকালে জাতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশে^র প্রায় সব স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিপ্লবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা সৃষ্টি, উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা প্রদানে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ক্রিয়াশীল থাকেন দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, লেখক, কবি, নাট্যকার বা চলচ্চিত্রকার হিসেবে বা অন্য কোনো ভূমিকায়। বুদ্ধিজীবীদের থাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নৈতিক সমর্থন; যা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। পাকিস্তানি সৈনিকদের আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসস্থল, কলাভবন, শহীদ মিনার, রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, মধুর ক্যান্টিন, বিশ^বিদ্যালয় সংলগ্ন অন্যান্য বাড়িঘর ও বসতি। জগন্নাথ হলে ৩৬ জন ছাত্র, রোকেয়া হলের কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৬ জনকে হত্যার পর গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়। পরিসংখ্যান বিভাগের রীডার এ এন এম মুনিরুজ্জামান, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, ড. ফজলুর রহমানসহ ১১ জন শিক্ষক পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার হয়।
১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বর্বরোচিত ঘটনা। মিরপুর, নাখালপাড়া, মোহাম্মদপুর, রাজারবাগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার প্রভৃতি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ রেখে যায়। শহীদ এ সকল বুদ্ধিজীবীদের দেহজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ-হাত-পা বাাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইক এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা মোট ১,০৭০ জন। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিম্নরূপ: শিক্ষাবিদ- ৯৯১ জন, চিকিৎসক- ৪৯ জন, সাংবাদিক- ১৩ জন, আইনজীবী- ৪২ জন এবং অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী)- ১৬ জন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ নামক প্রামাণ্য গ্রন্থে ১০০৯ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা উল্লেখ করে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিহত হন ৬৩৯ জন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক শিক্ষক, ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক এবং ৪১ জন আইনজীবী। তালিকাটি অসম্পূর্ণ হলেও তা থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে ছিল চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই সমগ্র দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজ শুরু হয়। ফলে অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে যেতে বাধ্য হলেও বিভিন্ন কারণে অনেক বুদ্ধিজীবীই রয়ে যান। তাঁদের ওপর যুদ্ধের বিভিন্ন সময় ধরপাকড় ও নির্যাতন চললেও তাঁরা হয়তো ভাবতেও পারেননি যে, নিজ দেশেই তাঁরা স্বজাতির মানুষ আল বদরের ও রাজাকারদের দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হতে পারেন। ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জয় যখন সুনিশ্চিত, এমতাবস্থায় পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য ছিল বাঙালি যদি কোনোভাবে জিতেও যায় তাহলে তারা যেন জাতি গঠনে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে এসে নিশ্চিত পরাজয় অনুধাবন করে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার জন্য রাও ফরমান আলীর নীল নকশা অনুযায়ী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল, তার শিকার হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের উন্নয়নে যারা সম্ভাব্য নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ছিলেন তাঁদের সরিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বলি হন সেসব প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীরা। এসকল বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন নিপীড়িত, নির্যাতিত গণমানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। দুর্বিনীত মানবতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী সত্তা হয়ে তাঁরা দুঃখী ও অধিকারবঞ্চিত বাঙালির সান্ত্বনা ও সেবার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকেদের শোষণ বঞ্চনায় বীতশ্রদ্ধ বুদ্ধিজীবীরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গতিশীল করতে তাত্ত্বিক ও বৌদ্ধিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী শিক্ষক-সাংবাদিক-পেশাজীবীরা বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ বপনের ক্ষেত্র তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসররা এসকল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিলেও দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য তাঁরা যে মহান আত্মত্যাগ করেছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় ও গণমানুষের হৃদয়ে শুদ্ধতম স্থানে উন্নীত করেছে। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনির্মাণে এসকল বুদ্ধিজীবীগণ চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়