আবদুল মান্নান »
করোনা কালে এমনিতে মুখে মাস্ক পরে রাস্তায় হাঁটতে হয়। প্রায়শ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বয়সও একটি ফ্যাক্টর বটে। তবে গত কিছু দিন ধরে দেশে করোনার সাথে ধর্ষণ নামের এক মহামারির আবির্ভাব হয়েছে তাতে এখন দম একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই মহামারি হতে কেউ বাদ যাচ্ছে না। ছোট শিশু হতে নব পরিনীতা বধূ, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা হতে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত। ধর্ষণ ঘটছে নিজ বাসায়, কলেজ হোস্টেলে, মাদ্রাসায় আর গির্জায়, বাসে আর স্কুলে, মন্দিরে আর মসজিদে। পিতার হাতে নিজ সন্তান, গির্জার পার্দ্ররি কাছে শিক্ষানবিশ মহিলা ধর্মযাজক, শিক্ষকের কাছে ছাত্রী, বাড়ির বড় কর্তার কাছে বাসার কাজের মানুষ, কোথাও কেউ বাদ যাচ্ছে না।
এমন ভয়াবহ ধর্ষণ মহামারি এই দেশের মানুষ একাত্তর ও ২০০১ এর নির্বাচনের পর আর দেখেনি। ধর্ষণ ছাড়াও মাদ্রাসায় ঘটছে বলাৎকার। আর এক শ্রেণির বদমতলবি মোল্লারা ইতোমধ্যে ঘোষণা করতে শুরু করেছেন, এই সব অপকর্ম বন্ধ করতে নাকি নারীকে পর্দার মধ্যে থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে । তাহলে কি মাদ্রাসার ছেলেরাও কি বোরকা পরে ঘুরবে ? পর্দার সাথে ধর্ষণের কোন সম্পর্ক নেই। যারা এই সব ফতোয় দেয় তারা কি ভুলে গেছে ২০১৯ সালে নেয়াখালির সোনাগাজি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় প্রিন্সিপ্যাল এস এম সিরাজুদৌল্লাহর কথা? দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল সিরাজুদৌল্লাহ সহ তার ষোল জন দোসরকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। ধর্ষণ আসলে একটা মানসিক রোগ ও বিকৃতি। এক সময় দিল্লীকে বলা হতো ধর্ষণের রাজধানী। এখনো দিল্লীর অবস্থান অটুট আছে। ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষিত মহিলা হয় দলিত বা নিম্নবর্গের। এই মুহূর্তে উত্তর প্রদেশের হাথারসে নামক স্থানে এক দলিত মেয়ের ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই দেশে তোলপাড় চলছে। মেয়েটি দিল্লীর এক হাসপাতলে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মারা গিয়েছে। ভারতে বছরে বত্রিশ হাজার নারী ধর্ষিত হয়। বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন চারজন। করোনা কালে এই সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বছর শেষ হওয়ার আগেই এই পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় এক হাজার ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। যা রিপোর্ট করা হয়নি তা যোগ করলে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
নোয়াখালির বেগমগঞ্জের ঘটনাতো বত্রিশ দিন পর জানাজানি হয়েছে। এলাকার মানুষ ঘটনাটা জানতো, শুধু জানতো না স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সভ্যসমাজে ধর্ষণের মতো একটি গর্হিত অপরাধ আর কিছু হতে পারে না যে কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশে ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ দ-। হতে পারে তা মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা দোষী ব্যক্তিকে সার্জারি করে নপুংসক করে দেয়া (পধংঃধৎধঃরড়হ) কিংবা গর্তের মধ্যে পুঁতে তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদ- কার্যকর করা।
গত কয়েকমাস যাবত যতজন দুর্বৃত্ত ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে তারা প্রায় সকলেই সরকারি দলের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
সরকার পরিবর্তন হলেও এদের অবস্থান পরিবর্তন হয় না, সব সময় সরকারি দলে থাকে। বর্তমানে এদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ, কোন রকমের বাছবিচার ছাড়া সব ধরণের দুর্বৃত্তের জন্য দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগে বানের পানির মতো ঢুকতে দেয়া হয়েছে। দলের কিছু অপরিণামদর্শী নেতা নিজেদের দল ভারি করার জন্য এই সব দুর্বৃত্তকে নিজেদের দলে রিক্রুট করে। এরা দলের কর্মী রিক্রুট করেন না, দূর্বৃত্ত রিক্রুট করেন। একবার দলে ভিড়তে পারলে তখন তারা হয়ে ওঠে ভয়ানক বেপরোয়া। এমন কোন বেআইনি কর্মকা- নেই যাতে তারা জড়িত হয় না। তারা জানে তাদের কিছু হবে না, তাদের নেতা তাদের সব সময় তাদেরর আগলে রাখবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে রাজনীতির যে, নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই করেছেন, পেশী ও বিত্তনির্ভর সেই সুবিধাবাদির রাজনীতি বর্তমান বাংলাদেশে গেড়ে বসেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পিতার রাজনীতিকে ধরে রাখতে কিন্তু তাঁকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করছেন এই রাজনৈতিক দূর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে যারা নানা অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে, যারা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের মতো অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে তাদের একটা বড় অংশ কিশোর বা তরুণ । দেশে এখন কিশোর গ্যাং সংষ্কৃতি বেশ রমরমা। এরা কাদের সন্তান? এদের কি বাবা মা নেই কি ভাবে উঠতি বয়সের একটি ছেলেকে অভিভাবকরা চুলকে বাহারি রংয়ে রং করতে দেন। তাদের অনেকে স্কুল কলেজের ছাত্র। তাদের শিক্ষকরাই বা কি করেন ? আমাদের সময় কোন ছাত্রের চুল লম্বা হলে স্কুলের মাস্টার মশাই বলে দিতেন সে চুল ছোট করে না আসলে ক্লাসে ঢুকতে দেবেন না। আমাদের অভিভাবকদের খুব বেশি পড়ালেখা ছিল না কিন্তু তারা পারিবারিক শৃঙ্খলার ব্যাপারে ছিলেন তারা জিরো টলারেন্স দেখাতেন। পরিবার ছিল আমাদেও প্রথম পাঠশালা আর মা বাবা প্রথম শিক্ষক। এই পাঠশালা এখন ভেঙে গেছে। যারা ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত এই কাজে তাদের লিপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাদের ক্ষমতার প্রদর্শন। তারা জানে তাদের ক্ষমতার উৎস স্থানীয় বড় ভাই। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অনেক আগেই এই বড় ভাইদের হুকুমদাস হয়ে গিয়েছেন।
সিলেট এমসি কলেজ বা বেগমগঞ্জের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত তাদের আটক করা হয়েছে । তারপর বিচারে কি হবে তা নিয়ে মানুষ নিশ্চিত হতে পারছে না। প্রথমে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা । সাধারণ মানুষ এই সব অপকর্মের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে চায়। শুধু অপরাধীদের বিচার নয়, এই সব অপরাধীদের পিছনের শক্তি যারা তাদেরও বিচার চায়। বঙ্গবন্ধু নানা অপরাধের দায়ে তাঁর দলের তেইশজন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করেছিলেন। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সব দুর্বৃত্তরা যাতে জামিন না পায় সেই ব্যবস্থা দেখতে চায় মানুষ। প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন হোক। গত নির্বাচনের আগে নোয়াখালির সুবর্ণচরে গৃহবধূ ধর্ষণের দায়ে আটক রুহুল আমিন জামিনে ছাড়া পেয়েছিল। এতে মানুষ হতাশ হয়েছে। অপরাধের শাস্তি না হলে এক সময় সাধারণ মানুষ আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয় যা রাষ্ট্রের জন্য বিপদ হতে পারে ।
সব শেষে ফুলন দেবীর কাহিনী দিয়ে শেষ করি। এই প্রজন্মের অনেকে ফুলন দেবীকে নাও চিনেত পারে। তার জীবনের কাহিনী সিনেমাকেও হার মানায় যদিও তার কাহিনী নিয়ে ভারতে সিনেমা হয়েছে। আশির দশকের ঘটনা। স্থান উত্তর প্রদেশ। দরিদ্র দলিত ঘরে জন্ম ফুলনের। বেড়ে উঠতে উঠতে এলাকার উচ্চবর্গের মানুষের নজর পড়ে ফুলনের ওপর যাদের অধিকাংশ আবার ডাকাত দলের সদস্য। নিয়মিত ধর্ষিত হয় তাদের হাতে। তাদের হাতেই মারা পরে ফুলনের প্রেমিক, যে নিজেও একজন ডাকাত ছিল। ফুলনকে ধরে নিয়ে বাইশজন ধর্ষক তেইশ দিন পালা করে তাকে ধর্ষণ করে। ফুলনকে উলঙ্গ করে গ্রামে ছেড়ে দেয়। একসময় ফুলন তার প্রেমিকের দলে যোগ দেয় এবং দলের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেয়। ফিরে আসে সেই গ্রামে যেখানে তার ধর্ষকরা থাকে। নিজ হাতে একে একে বাইশ জন ধর্ষককে সে হত্যা করে। ১৯৮৩ সালে ফুলন পুলিশের হাতে আত্মসমর্পন করে। তার বিরুদ্ধে ৪৮টি অপরাধের অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত। এগার বছর ফুলন জেলে কাটায়। মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। যোগ দেয় রাজনীতিতে। নির্বাচিত হন ভারতীয় লোকসভার সদস্য হিসেবে। ফুলনের কাহিনী অনেক দীর্ঘ। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে একাধিক ভাষায় উপন্যাস, তৈরি করা হয়েছে সিনেমা। মিডিয়ার বদৌলতে ফুলন মাল্লাহ হয়ে গেছেন ফুলন দেবী। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশেও কোন এক সময় আবির্ভাব হতে পারে একজন ফুলন দেবীর।
প্রধানমন্ত্রী ইতোপূর্বে একাধিকবার নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি নিজে একজন নারী হওয়াতে নারীর বিরুদ্ধে এই সব অপরাধের বেদনা বুঝেন। দেশের মানুষ সব কিছুর জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই ধর্ষণ সমস্যার লাগাম টেনে ধরার জন্য এবারও তিনি ভূমিকা রাখবেন বলে মানুষ আশা করে। দেশের সকল মানুষ প্রাণভরে মুক্ত বাতাস নিতে চায়। কিন্তু ধর্ষক বা তাদের মতো অপরাধীরা নির্বিঘেœ ঘুরে বেড়ালে দেশের মানুষ নিজেদের অসহায় মনে করে। সকল যৌন নিপীড়কের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করছি।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক