জিয়াবুল হক, টেকনাফ »
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন হয়েছেন অন্তত ১৫ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ডাকাতি। নিহতদের অধিকাংশই ক্যাম্পের নেতা বা স্বেচ্ছাসেবক।
সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা জানায়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব না মানার প্রবণতা, অপরাধকর্মে বাধা দেয়া এবং আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব খুন হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকারের কথা বলতে না পারেন তার জন্য এসব টার্গেট খুন বলে মত রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞদের।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫টি হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মাসে ১৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক।
উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ৩টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এসব এপিবিএন এর তথ্যমতে, গত ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।
এ ব্যাপারে ৮ এপিবিএন এর উপঅধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর একটি মাদ্রাসায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে। এসব হত্যাকা-ের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন, তখন বিকল্প হিসেবে চালু হয় স্বেচ্ছায় পাহারার। ক্যাম্পটির প্রতিটি ব্লকে পাঁচজন করে রাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়া শুরু করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ৮ এপিবিএন এর আওতাধীন ১১টি ক্যাম্পের ৬৪টি ব্লকের ৭৭৩টি সাব-ব্লকে চালু হয় এ স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা। প্রতি রাতে ৩ হাজার ৮৬৫ জন রোহিঙ্গা পাহারা দিচ্ছে এ ১১টি ক্যাম্প। তারা কোন সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা, চিহ্নিত অপরাধী, মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের তথ্য দিচ্ছে এপিবিএন’কে।
তিনি আরও জানান, গত ২৩ অক্টোবর থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মত অপরাধ কমেছে কয়েকগুণ। অপরদিকে মাদক উদ্ধার বেড়েছে ৩ দশমিক ৬৬ গুণ, অস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ গুণ আর গ্রেফতারের সংখ্যা বেড়েছে ৩ দশমিক ৬৩ গুণ।
রবিউল ইসলাম জানান, জামতলী ক্যাম্প থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা এখন উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলছে। তিনি জানান, স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়ার এই পদ্ধতির কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। এর জের ধরে এসব অপরাধী এখন স্বেচ্ছাসেবক এবং মাঝিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেছে। এতে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝিরাও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জানান, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ, যিনি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হন তিনি। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠা মেনে নিতে না পেরে রোহিঙ্গাদেরই একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে।
তিনি জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-টি সুনির্দিষ্ট টার্গেট কিলিং হিসেবে ধরা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, হওয়ার চেষ্টা এমন মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় খুন করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের উদ্যোগে বা আধিপত্য বিস্তারে খুন করছেন এমনটা মনে হচ্ছে না। এখানে ভিন্ন কোনো মহলের ইন্ধন থাকতে পারে।
উখিয়া কুতুপালং এলাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।’
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় যেসব মামলা হয় তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকেও সহায়তা দেয়া হচ্ছে।