নিজস্ব প্রতিনিধি, কক্সবাজার »
কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আবারও দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলিতে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ঘটনাস্থলে তিনজন ও হাসপাতালে নেওয়ার পর দুইজন মারা যান। গোলাগুলির ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে থমথমে পরিস্থিতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে রোহিঙ্গা সূত্রে জানা গেছে।
তবে পুলিশ সূত্র জানায়, পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক ও তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে উখিয়ার ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টে এই ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, ক্যাম্প-৮ ওয়েস্ট বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২৪), মোহাম্মদ হামীম (১৬), ক্যাম্প-১৩ এর নুরুল আমিন (২৪) ও ক্যাম্প-১০ এর মো. নজিমুল্লাহ। আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এর আগেও একাধিক ক্যাম্প নেতা, উপ-নেতা ও সাধারণ রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরাই ক্যাম্পে খুনাখুনি করে চলেছে।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১১ জন আরসার সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্য ব্যক্তিরা সাধারণ রোহিঙ্গা।
এদিকে, ৮ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, শুক্রবার ভোরে ক্যাম্পে দুই দল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিন জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আহত আরও দুই জনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারাও সেখানে মারা যান। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
আবদুস সালাম, জুবায়েরসহ বেশ’কজন রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে কিছু দিন ধরে ওই দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এরই সূত্র ধরে ভোরে দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি চলে। এতে পাঁচজন নিহত হয়। এ ঘটনায় পুরো ক্যাম্পজুড়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বক্তব্যে আরসা ও আরএসও নামে দুটি বিবদমান গ্রুপের নাম উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে ৮-এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুনোখুনি বাড়ছে। এরই মধ্যে ভোরে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় পাঁচ জন নিহত হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে নিহতরা সবাই আরসার সদস্য।
তিনি বলেন, কে আরসা, কে আরএসও সেটি বিষয় নয়। ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা- চলবে না। যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এই হত্যাকারীদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
অপরদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের ১-পশ্চিম নম্বর ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে এবাদুল্লাহ নামে এক কমিউনিটি নেতা (সাব মাঝি) নিহত হয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩৭টি হত্যাকা- হয়েছে। আর এ বছর গত ছয় মাসে ১৭ রোহিঙ্গা মাঝিসহ ৫১ জন খুন হয়েছেন।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কমিউনিটি নেতাদের হামলা করে হত্যা করছে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। প্রথমটি হচ্ছে, এই সংগঠনগুলো সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে চায় না। যদি কেউ তথ্য দেয়, সংগঠনগুলো সেই তথ্যদাতার পরিচয় জেনে যায়। পরে ওই তথ্যদাতার ওপর হামলা চালানো হয়। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আগে অনেক মাঝি সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতেন, কিন্তু এখন আর করেন না। যারা সহযোগিতা করেন না, তারা মুনাফিক হয়ে গেছে বলে টার্গেট করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২৬ জুন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) এইচ-৫৯ ব্লকে আশিক এলাহী (২৩) নামের এক রোহিঙ্গা তরুণকে হাত-পা বেঁধে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে আরসার সন্ত্রাসীরা আশিককে ঘর থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।
এর আগে ১৯ জুন সকালে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ) মিয়ানমারের সশস্ত্র দুটি গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারেটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় ইমাম হোসেন (১৫) নামের আরেক রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন মোহাম্মদ নুর (৪৭) নামের আরেক রোহিঙ্গা। এভাবেই চলে একের পর এক খুনের ঘটনা।
উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, শুক্রবারে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালানো হয়েছে।