উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটকে বিস্ফোরণোন্মুখ জনতা

মোহীত উল আলম »

রাজা ক্লডিয়াসকে লেয়ার্টিস জিজ্ঞেস করছেন, আপনি যখন জানলেন যে হ্যামলেটই আমার পিতার হত্যাকারী তখন আপনি তাঁকে গ্রেপ্তার করলেন না কেন? ক্লডিয়াস বললেন, দু’টো কারণে। এক, হ্যামলেটের মা অর্থাৎ রানি গার্ট্রুড তার প্রতি অন্ধ স্নেহ পোষণ করেন। দ্বিতীয় কারণ হ্যামলেটের জনপ্রিয়তা: “দ্য গ্রেট লাভ দ্য জেনারেল জেন্ডার বেয়ার হিম” (৪.৭.১৮)। সাধারণ মানুষের তাঁর প্রতি ব্যাপক ভালোবাসা।
রাস্তায় বেরিয়ে আসা উন্মত্ত জনগণ যে কোন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শাসকবর্গের জন্য ভীতিকর। এই একই নাটকে যখন লেয়ার্টিস তাঁর পিতা পোলোনিয়াসের মৃত্যুর খবর শুনে ফ্রান্স থেকে ডেনমার্কে ছুটে আসেন, তিনি তখন কেবলই প্রতিহিংসায় জ্বলছেন। তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে জনগণও তাঁর পেছনে নেমেছেন। লেয়ার্টিস এই উন্মত্ত জনতা নিয়ে প্রাসাদের দরজায় আঘাত করলেন। বার্তাবাহক জনগণের এই উন্মত্ততার খবর রাজাকে দিচ্ছেন এ ভাবে: “দ্য র‌্যাবল কল হিম লর্ড . . . / দে ক্রাই, ‘চূজ উই! লেয়ার্টিস শ্যাল বি কিং।’ / ক্যাপস, হ্যান্ডস এ্যান্ড টাংস এপ্লড ইট টু দ্য ক্লাউডস / ‘লেয়ার্টিস শ্যাল বি কিং, লেয়ার্টিস কিং।’ (৪.৫.১০২, ১০৬-৮)।
উন্মত্ত জনগণ আকাশে টুপি ছুঁড়ে বলছে, লেয়ার্টিসই রাজা হবে, লেয়ার্টিসই রাজা।
কিন্তু শেক্সপিয়ারের দেশ ইংল্যান্ডে রাজবংশের সরাসরি উত্তরাধিকার না হলে রাজা হওয়া সম্ভব নয়। হ্যামলেট নাটকটির দৃশ্যপট ইংল্যান্ডে নয়, ডেনমার্কে। কিন্তু সে দেশে যে ইংল্যান্ডের মতো বংশনীতি কাজ করে না, সে খবরতো শেক্সপিয়ারের জানা ছিল না। আবার উন্মত্ত জনতারও জানা থাকার কথা নয় যে লেয়ার্টিস কোনভাবেই ক্লডিয়াসের পদভিষিক্ত হতে পারে না।
শেক্সপিয়ারের সমগ্র সাহিত্য পড়ে বোঝা যায় তিনি মোটেও উন্মত্ত জনতার রোষের বিপ্লবী চরিত্রের পক্ষে ছিলেন না। বরঞ্চ জনমতের মধ্যে দোদুল্যমানতাকেই তিনি লক্ষ্য করে সমালোচনা করেছেন। হ্যামলেট নাটকের বছরখানেক আগে লেখা রোমান ঐতিহাসিক নাটক জুলিয়াস সিজার-এর প্রথম দৃশ্যেই দেখা যাচ্ছে জনতা রোমের রাস্তায় ভিড় করেছে বীর বেশে আগমনকারী জুলিয়াস সিজারকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। কিন্তু সিজারের বিরুদ্ধবাদী সিনেটর ফ্লভিয়াস আর মুরেলাসের এটি পছন্দ নয়। তাঁরা রাস্তায় ভিড় করা কামার, ছুতার, মুচি এইসব নিম্ন শ্রেণীর লোকদের “ইউ ব্লকস, ইউ স্টৌনস, ইউ ওর্স দ্যান সেন্সলেস থিংস” (১.১.৩৬)— তোমরা বুদ্ধু, তোমরা পাথর, তোমরা বোধশক্তিহীন পদার্থ বলে গালাগাল করেন।
কিন্তু জুলিয়াস সিজার নিহত হলে রোমের জনগণকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। সিজারের মৃতদেহ সিনেট ভবনের বাইরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। জনতা ভিড় করে আছে। তারা জানতে চায় সিজারকে কেন মারা হলো। সিজারের হত্যাকারীরা যেমন ক্যাসিয়াস, কাসকা, ব্রুটাস প্রমুখ সিজারের হত্যাকাণ্ডকে যথার্থ কারণে করা হয়েছে বলে ভাষণ রাখলেন। জনগণ আস্বস্ত হলো। কিন্তু সিজারের একান্ত বন্ধু, যিনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, তাঁকে ভাষণ দিতে বলা হলো। মার্ক এ্যান্টোনি অবস্থা জরীপ করে বুঝলেন এখানে সিজারের সমর্থনে কথা বলা বিপদ। তখন তিনি “ফ্রেন্ডস, রোমানস, কান্ট্রিমেন, লেন্ড মি ইয়োর ইয়ার্স” (৩.২.৭৪), বলে যে বক্তৃতাটি দিলেন সেটি বক্তৃতাশিল্পে অত্যন্ত উৎকর্ষ হিসেবে ধরা হয়। শুনেছি? সামরিক বিজ্ঞান বিষয়েও এই বক্তৃতার কৌশলটি শেখানো হয় রিটারিকের অংশ হিসাবে। এ্যান্টোনি এমনভাবে, অসরাসরিভাবে, সিজারের গুণকীর্তন করলেন যে, উপস্থিত জনতা যারা এতক্ষণ ব্রুটাস ও অন্য হত্যাকারীদের পক্ষে ছিল, তারা ক্ষেপলো তাঁদেরই বিরুদ্ধে। এমন যে সিজারের সকল হত্যাকারীকে মুহূর্তেই রোম ছাড়তে হলো।
কিন্তু রোষোন্মত্ত জনগণ মাত্রই যে ভুল করতে পারে সেটি শেক্সপিয়ারের নজর এড়ায় না। সিজারের হত্যাকারীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল সিন্না, যিনি সিজারের মৃত্যুর পরপরই চিৎকার করে বলেছিলেন, “লিবার্টি! ফ্রিডম, টিরানি ইজ ডেড” (৩.১.৭৮-৭৯), স্বাধীনতা, মুক্তি, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। কিন্তু সেই সিন্না মনে করে রুদ্ররোষে আকুল জনগণ বা প্লিবিয়ানরা সিন্না নামক এক কবিকে মেরে ফেলে ষড়যন্ত্রকারীদের দোসর হিসেবে। সিন্নাকে উন্মত্ত জনগণ জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? সিন্না বল্লেন, আমি কবি সিন্না, ষড়যন্ত্রকারী সিন্না নই। তখন তৃতীয় প্লিবিয়ান বলে, তুমি খুব খারাপ কবিতা লেখ, তোমার ফাঁসি হওয়া উচিত। আর, ৪র্থ প্লিবিয়ান বলে, নামের যখন মিল আছে, ওকেও মেরে ফেল: “ইট ইজ নো ম্যাটার, হিজ নেইমজ সিন্না।” (৪.১.৩৩)
এ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা (১৬০৬) নাটকে জনসমর্থনের দোদুল্যমানতা নিয়ে একটি অত্যাশ্চর্য চিত্রকল্প আছে। এ্যাকটিয়াম যুদ্ধে অক্টেভিয়াস সিজারের হাতে পরাজয়ের পর এ্যান্টোনি তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য ক্লিওপেট্রাকে দায়ী করেন। তিনি ভুল ভাবলেন যে ক্লিওপেট্রা গোপনে সিজারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তাঁর সমর্থকেরা তাঁর ভাগ্যের পতন দেখে দলে দলে সিজারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে লাগলো। তখন এ্যান্টোনি তাঁর অনুধাবণ ব্যক্ত করেন এভাবে: “দ্য হার্টস দ্যাট এস্পেনিয়েলড মি এ্যাট হিলস, টু হোম আই গেইভ / দেয়ার উইশেস, ডু ডিসক্যান্ডি, মেল্ট দেয়ার সুইটস / অন ব্লসমিং সিজার।” (৪.১২.২০-২৩)। যারা আগে আমাকে বাধ্য এস্পেনিয়েল কুকুরের মতো অনুসরণ করতো, তাদের সে আনুগত্য এখন গলে গিয়ে প্রস্ফুটোন্মুখ সিজারের ওপর ঝরে পড়ছে। অনুসরণের চিত্রকল্পটি এস্পেনিয়েল কুকুরের মধ্য দিয়ে দারুণভাবে ফোটালেন শেক্সপিয়ার।
জনগণের সমর্থন নিয়ে আর দুটো নাটকের কথা বলে আলোচনাটি শেষ করব। কোরিওলেনাস (১৬০৭-৮) নাটকের শুরুতেই আছে রোমের বিদ্রোহী জনগণের সঙ্গে শাসকশ্রেণির মুখোমুখি হওয়া। সাধারণ জনগণ গম পাচ্ছে না খেতে। তারা দাবি করছে গমের গুদাম খুলে দেওয়া হোক, তা না হলে তারা লুটতরাজে নামবে। তারা দরকার হলে লড়াই করবে কিন্তু অভুক্ত থাকবে না। ১ম সিটিজেন বলছে, “ইউ আর অল রিজলভড টু ডাই দ্যান টু ফেমিশ?” (১.১.৩) মেনেনিয়াস নামক একজন অভিজাত প্রৌঢ় তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে শাসকবর্গ হচ্ছে শরীরের পেটের মতো। পেট আপাত:দৃষ্টিতে কিছু করে না, কিন্তু সে যদি একবার তার কাছে জমাকৃত খাদ্য শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন হাত ও পা-কে সরবরাহ না করে, তা হলে হাত পা দুর্বল হয়ে যাবে। তাই শরীরে পেটের যে গুরুত্ব, রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণির গুরুত্বও সেরকমের। তারা হয়তো দৃশ্যমানভাবে ফসল উৎপাদনে নেই, কিন্তু তারা পরিচালনা না করলে, শস্য গুদামজাত না করলে, তখন প্লিবিয়ানদেরকে দুর্দিনে কে খাবার দেবে! রোমের জনগণ মেনেনিয়াসের গল্পে যে সন্তুষ্ট হয় তা নয়, কিন্তু নাটকটির নায়ক কোরিওলেনাসের জীবনে জনগণের সমর্থন প্রত্যাহার হবার কারণে তাঁর দুর্গতির শুরু হয়। অথচ এই কোরিওলেনাসই বারবার রোমকে বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল।
১৪৫০-এর কিছু আগে জ্যাক কেইড নামক কেন্ট কাউন্টির একজন লোক রাজা ষষ্ঠ হেনরির রাজত্বে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি বিরাট একটা সমর্থক বাহিনী নিয়ে লন্ডনের পথে রওয়ানা হোন। তিনি অবশ্য বলেন যে রাজার বিরুদ্ধে তাঁর কোন অভিযোগ নেই, কিন্তু তাঁর আশেপাশের লোকদের শায়েস্তা করতে হবে। কিন্তু তাঁর পরিচালিত বিদ্রোহ সহসা দম হারিয়ে ফেলে এবং ১৪৫০ সালে তিনি নিহত হোন।
কিন্তু শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক রাজা ষষ্ঠ হেনরি, পার্ট টুতে কেইডের বিদ্রোহকে খানিকটা রম্য করে তোলেন। শেক্সপিয়ারের কেইড প্রথম আপত্তি তোলেন লেখাপড়ার বিরুদ্ধে। তাঁর সহযোগী বুচার বলেন: “দ্য ফার্স্ট থিং উই ডু, লেটস কিল অল দ্য লইয়ার্স।” (৪.২.৭২)। আর একজন শিক্ষিত কলমবিদকে কেইড ফাঁসিতে দেন যেহেতু সে লেখাপড়া জানে: “এ্যাওয়ে উইথ হিম, আই সে! হ্যাং হিম উইথ হিজ পেন এ্যান্ড ইনকহর্ন এবাউট হিজ নেক।” (৪.২.১০২-৩)
কেইডের মৃত্যু হয় ইডেন নামক একজন অভিজাত লোকের হাতে। যখন তাঁর বিদ্রোহ দমন করা হয় কেইড তখন ইডেনের বাগানে লুকিয়ে থেকে পাঁচদিন অভুক্ত থাকার পর মরণাপন্ন অবস্থায় চলে যান। কারণ, ধরা পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে পারছিলেন না। পরে তিনি এত ক্ষুধাকাতর হয়ে পড়েন যে, তখন তিনি বলেন, আমি যদি আরও হাজার বছর বাঁচি কিছু না, যদি এই মুহূর্তে আমি কিছু খেতে না পারি।
কেইড উন্মত্ত জনগণের নেতা হয়েও নিজের শেষ রক্ষা করতে পারলেন না।
সেই জন্য বলছি, শেক্সপিয়ার তাঁর নাটকগুলোতে জনগণের বিদ্রোহ, বা তাদের বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থার কথা বিধৃত করলেও, তিনি প্রচলিত সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হোক সেটি চাননি। তাঁর একটা নিশ্চয় রক্ষণশীল অবস্থান ছিল সেজন্য তাঁর নাটকে জনতার আন্দোলনের কথা যখনই এসেছে তখন তিনি তাদের মূর্খতা ও দোদুল্যমানতার বিষয়গুলি স্পষ্ট করেছেন, তাদের মাহাত্ম্য বা সংগ্রামী চরিত্রের কথা নয়।