কোরবানি নিয়ে আলোচনা করতে আমি দুটো প্রসঙ্গ নিয়ে আসব। একটি ধর্মীয়, আরেকটি সামাজিক।
১. কোরবানির ধর্মীয় ও তাত্ত্বিক ভিত্তি :
কোরবানি শব্দটার উৎপত্তি আরবী শব্দ ‘কুর্ব’ থেকে, আর কুর্বের অর্থ হচ্ছে নৈকট্য। আল্লাহ্র সঙ্গে নৈকট্য। কোরবানির দিন জায়েজকৃত পশু উৎসর্গ করে প্রতীকি অর্থে ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করতে প্রত্যাশী হয়।
পবিত্র আল কোরানের ৩৭ নম্বর সুরা ‘ছোয়াফ্ফাত’-র ১০০ থেকে ১০৬ নম্বর আয়াতে আছে যে হযরত ইব্রাহীম (আ:) নিজের পিতা সহ পৌত্তলিক লোকদের নাস্তিক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা নগরীতে আসলেন। আল্লাহ্র কাছে র্প্রাথনা করলেন, ‘রাব্বি হাব্লী মিনাছ ছোয়ালিহিন’, র্অথাৎ ‘হে আমার রব! আমাকে নেককার সন্তান দাও।’ আল্লাহ্ বলছেন, ‘আমি তাকে সহিষ্ণু পুত্রের সংবাদ প্রদান করলাম।’ পবিত্র বাইবেলে (জেনেসিস ১৬) বলা হচ্ছে এ ঘটনার সময় ইব্রাহীম (আ:)-র বয়স ছিল ছিয়াশি। তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাইল (আ:)-র জন্ম হলো। ইসমাইল বালক বয়সে পৌঁছালে যখন তিনি পিতার নয়নের মণি, তখন পরপর দু ‘দিন ইব্রাহীম (আ:) স্বপ্নে দেখলেন যে তাঁর প্রিয় পুত্রকে আল্লাহ্র নামে বধ করতে হবে। শয়তান এ খবর জানতে পেরে ইব্রাহীম (আ:)-কে বোঝালো যে এটি উৎসর্গ নয়, এটি হবে হত্যাকান্ড, পিতা কর্তৃক পুত্রের জীবন নাশ। পুত্রকে হত্যা করতে এই স্বপ্ন তাঁকে প্রলোভিত করছে। ইব্রাহীম (আ: ) শয়তানের ফাঁদে পা দিলেন না, বরঞ্চ বালক পুত্রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলেন। বালক ইসমাইল (আ: ) সাথে সাথে রাজি, এবং বললেন পিতা, তুমিতো আমাকে বেশি ভালোবাসো, আমি মরছি এই দৃশ্যটা তুমি সহ্য করতে পারবে না, তাই তুমি চোখের ওপর একটি কাপড় দিয়ে রেখ। উৎসর্গের দিন পুত্রকে পিতা উপুড় করে শোওয়ালেন যাতে পুত্রের মুখ দেখতে না হয়। এবং যে মাত্র পুত্রের ঘাড়ে খঞ্জরটা ছোঁওয়ালেন অমনি অদৃশ্য একটি বাণী ভেসে এল, যেটা বলছে, ‘হে ইব্রাহীম, আমি আমার প্রতি তোমার ভক্তির পরীক্ষা করছিলাম, দেখছিলাম সেটা শত ভাগ খাঁটি কিনা, এবং সেটাতে তুমি পাশ করেছো। এখন চোখ খুলে দেখ, তোমার পুত্রের জায়গায় আমি একটা দুম্বা দিয়েছি।’ ইব্রাহীম (আ: ) চোখ থেকে কাপড় খসিয়ে দেখলেন পুত্রের জায়গায় একটি দুম্বা কাটা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তাঁর পুত্র তাঁর পাশে হাস্যমুখে সর্ম্পূণ অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। ।
আরও একটি বিষয় লক্ষ করার আছে। ইসমাইল (আ:) যখন একান্ত নবজাতক বা পরবর্তী পর্যায়ের শিশু ছিলেন তখন তাঁকে উৎসর্গ করার আদেশ আল্লাহ্র নিকট থেকে বাবা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর কাছে আসে নি, কিন্তু যখন তিনি কথা বলা এবং হাঁটতে শিখেছেন, বা যখন তিনি নয় দশ বছরের নাদুসনুদুস বালক, যখন বাপের সঙ্গে মাঠে যাবার উপযুক্ত হয়েছেন, যখন মাঠ থেকে ফিরে তিনি মাতা বিবি হাজেরার কাছে গল্প করতেন, তখন অর্থাৎ যখন শিশু বাবা-মা’র কাছে সবচেয়ে বেশি আদুরে হয়ে ওঠে, যখন তাকে হারানোর স্মৃতি বাবা-মা’র মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কাটে, তখনই কিন্তু আল্লাহ্র নির্দেশটা আসলো।
পবিত্র কোরানের ইংরেজির মান্যবর অনুবাদক আব্দুল্লাহ্ ইউসুফ আলী বলছেন, লক্ষ্যণীয় যে এখানে জীবনত্যাগের ক্ষেত্রে পিতাপুত্র দুজনেই রাজি ছিলেন। যার অর্থ আল্লাহ্র আজ্ঞা তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে পালনে ব্রতী ছিলেন। আলী আরও বলছেন, পুরো ব্যাপারটাই প্রতীকী, কারণ ২২ নম্বর সুরা “হজ্ব”-এর ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ্র কাছে জবাইকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, এটা শুধুু ত্ত্বাকওয়া।’
ত্যাগ বা স্যাক্রিফাইস করার এই ত্ত্বাকওয়াটইি হচ্ছে কোরবানির মূল তাৎর্পয।
তবে ইসলাম ধর্ম ছাড়াও কোরবানির অনুরূপ বলিদান বা উৎসর্গ-অনুষ্ঠান শুধু প্রাচীন সনাতন ধর্ম সহ, ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মে নয়, প্রাচীন গোত্রীয় সমাজের বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে যজ্ঞপ্রথা চালু ছিল। ফরাসী দার্শনিক ও নৃতত্ত্ববিদ রেনে জিরার্ড তাঁর “দ্য স্যাক্রিফিসিয়াল ক্রাইসিস” বা ‘বলিদান রীতির সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধে সৃষ্টিকর্তার প্রতি উৎসর্গীকৃত বলিদানের পর্বে বিরাজমান একটি সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। বলছেন, বলিদান পর্বটি মূলত একটি সাবস্টিটিউট বা বিকল্পপ্রথা থেকে কার্যকর। যেমন আমরা যদি ইসলামের কথায় আসি, সেখানে ইসমাইল (আ:)-এর বিকল্প হয়ে পড়ল দুম্বাটি। কিন্তু বলিদানের ক্ষেত্রে যদি বলিদানকারীর লোভ বা কোন পার্থিব লক্ষ্য চাপাভাবেও অস্তিত্বমান থাকে তা হলে সেটি বলিদান বা স্যাক্রিফাইস না হয়ে হবে হত্যাকান্ড বা মার্ডার। বলিদান কখন ঈশ্বরের (ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের প্রসঙ্গে আসলে সৃষ্টিকর্তার জায়গায় আমি ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করি।) জন্য পবিত্র ও শুচিকরভাবে নিবেদিত হলো, আর কখন তা নিছক হত্যাকান্ডে পরিণত হলো এ সূক্ষ্ম সীমারেখাটি বোঝা বা রক্ষা করা খুবই কঠিন। সে অর্থে আমরা কোরবানি উপলক্ষে যে ত্ত্বাকওয়া নিয়ে পশু আল্লাহ্র তরফে উৎসর্গ করি, সেটি কখন পরিপূর্ণ আল্লাহ্র তরফে কোরবানিস্বরূপ উৎসর্গীকৃত হলো এবং কখন কসাই দিয়ে হাটে গরু জবাইএর মতো অবমানাকর কাজ হলো সেটা সামাজিক মানুষ আমাদের জন্য বোঝা খুবই কষ্টকর। যদিও কোরবানি দেবার সময় আমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ একটি আত্মত্যাগের মনোবাঞ্ছা থাকা উচিত, কিন্তু আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বরঞ্চ লোভ, প্রতিযোগিতামূলক প্রবৃত্তি, সংশয়, এবং নিরেট মাংসপ্রীতি আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এটাই হলো সংকট। এই সংকটের কারণে কোরবানির পবিত্র ত্যাগযজ্ঞ নিছক জবাইকারী অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হবার আশংকা থাকে।
২. কোরবানির সামাজিক ভিত্তি :
বাংলাদেশের মতো দরীদ্র জনগোষ্ঠীভিত্তিক সমাজে কোরবানি পবিত্র ধর্মীয় উৎসব হিসেবে এলেও এটি কিন্তু প্রচন্ড অর্থনৈতিক চাপের মুখে ফেলে অধিকাংশ জনগণকে। ধর্মীয় চেতনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কোন বিশ্বাসী লোক কোন একটা পশু কোরবানি দিতে চায়। একটি গরু, কিংবা একটি ছাগল বা ভেড়া, কিংবা ভাগে গরু দিয়ে সে কোরবানিটা করতে চায়, কিন্তু তার সে চাওয়াটাকে বাস্তবে পরিণত করতে তার সাধ্য আছে কিনা! যে কোন ধর্মীয় উপাচার পালনে সবচেয়ে বড় সংকট হলো এর সঙ্গে অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা। রোজার ঈদের সময় বাংলাদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী যে রকম আয় ও ব্যয়ের মধ্যে লড়াইয়ে নামে কোরবানির সময় এই দ্বন্দ্বটা কয়েকগুণ তীব্রতা লাভ করে কারণ ঈদের বাজারে ব্যয়ের পরিমাণ আয়ের ওপর নির্ভর করে বাড়ানো বা কমানো যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কোরবানির সময় একটি নির্দিষ্ট খরচের নীচে ব্যয় কমানোই যায় না। আপনাকেতো গরুটা বা ছাগলটা কিনতেই হবে। নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের জন্য পশু কোরবানি দেয়া রীতিমতো একটি এসিড টেস্ট।
ক্রেতাপক্ষের এই অসহায়ত্বের পুরো সুযোগটা নেয় বিক্রেতা পক্ষ। যে গরুর দাম দেখতে ৬০ হাজার টাকা হতে পারে বড়জোর, সে গরুর দাম হাঁকানো হয় দেড় লক্ষ থেকে পৌণে দুই লাখ। তদুপরি, বাংলাদেশের দৃশ্যমান সমৃদ্ধির কারণে শহরে ও গ্রামেগঞ্জে ব্যক্তিগত মালিকানায় গড়ে ওঠা অজস্র মাঝারি আর বড় খামারে (এগ্রোফার্ম) প্রজননকৃত বিশাল বিশাল গরুর ছবি দেখে অবাক হচ্ছে মানুষ। আগে যে ধরনের গরু অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, বা নেদারল্যান্ডসে দেখতাম, তার চেয়েও সরস গরু এখন বাংলাদেশের খামারগুলোতে দেদারসে প্রজননকৃত হচ্ছে। এগুলোর নাম ‘রাজা’,’বাদশা’, মহারাজ’, ‘কালা’, ‘ধলা’ ইত্যাদি। একটা ভিডিও পেলাম, এক হাতীর সমান অত্যন্ত সুশ্রী গরুর কথা বলছেন এর মালিক যে এটার দাম তিনি এক কোটি দশ লক্ষ হাঁকিয়েছেন গরুটির মাংসের পরিমাণের জন্য নয়, বা এর সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরঞ্চ এর ‘বংশ মর্যাদার’ (?) জন্য কেননা গরুটি নাকি আমেরিকার একটি রাজকীয় বংশের গরু। এবারে চট্টগ্রামের বাজারে নাম করছে লাল রঙের ষাঁড়, ‘দ্য রেড চিটাগাং ক্যাটল’। সুদৃশ্য এই ষাঁড়টি আকারে ছোট কিন্তু খুব তরতাজা দেখতে।
কোরবানি পশুর বাণিজ্যিকিকরণের আরেকটা বিরাট সমস্যা হলো মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের উৎপাত। এই শ্রেণিটি হচ্ছে কর্তৃত্বপ্রধান রাজনৈতিক দলটির তথাকথিত নেতা, কর্মী বা সমর্থক। এরা গবাদিপশুর ব্যবসায়ী নয়, কিন্তু কোরবানি আসলে এদের কর্মতৎপরতা উৎপীড়নের পর্যায়ে যায়। এরা ‘ডাক’ পায়। ‘ডাক’ পাওয়ার অর্থ হচ্ছে এরা অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর অনুমতি পায়। যে ‘ডাক’ পায় সে তখন যে কোন অনুমোদিত জায়গায় গরুর বিক্রেতাদেরকে গরু নিয়ে আসার জন্য পরিবেশ বা হাট তৈরি করে দেয়। এটিকে গণমাধ্যমে “খুঁটি”র ব্যবসাও বলা হয়। এই খুঁটির দখলদারিত্ব নেবার জন্য গরুর খামারীদেরকে ঐ ভুঁইফোড় নেতাকে বা তার লোকদের একটি বখরা দিতে হয়। ঐ অতিরিক্ত বখরার দায়টা গিয়ে পড়ে পশুর ক্রেতার ওপর। ফলে কোরবানি উপলক্ষ্যে পশু বাণিজ্যের অরাজকতার চূড়ান্ত শিকার হচ্ছে ক্রেতা বা আমি বা আপনি।
কোরবানির গরুর হাটের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে নাড়ীর সম্পর্ক হলো চামড়া শিল্পের। যদিও কোরবানিকে পশুপ্রেমী জনগণ একান্তই সমালোচনার চোখে দেখে, কিন্তু কোরবানির কারণেই ব্যাপক চামড়া শিল্পের উদ্বোধন হয়। কোরবানির এই অর্থনৈতিক উজ্জ্বল দিকটা উপক্ষো করার নয়। তবে এখানেও কোরবানিদাতা আরেক ধরনের শিকার। কারণ আগে কোরবানি দিয়ে একটি শান্তি থাকত যে গরুর চামড়াটা ভালো দামে বিক্রি করে গরীবদের মাঝে সে টাকাটা বিলিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু সাত-আট বছর ধরে এই শান্তি চলে গেছে বলা যায়। চামড়ার কোন দামই পাওয়া যায় না। মাত্র একশো দেড়শো টাকায় লাখ দেড়লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়া বিক্রি করে দিতে হয়। সরকারের কাছে অনুরোধ রইলো কোরবানির বর্জ্য চামড়া নিয়ে এই অস্থিরতা নিরসনে যেন উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ