হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই সমস্ত প্রশংসা ও স্তুতির মালিক, যিনি নিজ দয়ায় আমাদেরকে তাঁর প্রশংসা করার ভাষা ও অবকাশ দিয়েছেন। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি পবিত্র বান্দাদের ভালবাসেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি কৃতজ্ঞ বান্দাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপাসনায় কারো অংশীদারিত্ব নেই। আমাদের কা-ারী ও মুনিব হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র প্রিয়তম বান্দা ও তাঁর শ্রেষ্ঠতম রাসূল।
আমরা একথা সবাই জানি যে, আমাদের মৃত্যুর বিষয়টি যতটা নিশ্চিত, জীবনের স্থিতি ও আয়ু নির্ধারণ ততটাই অনিশ্চিত। আর পরকালে বিচার পূর্বক পুরস্কার বা শাস্তি ইহকালের বিশ্বাস ও কর্মভিত্তিক। ইহজীবন আমাদের কর্ম সম্পাদনের। অর্থাৎ এ জীবন ভাল বা মন্দ আমল অর্জন করার অবকাশ। আর পরকাল তার সুফল বা কুফল ভোগ করার অনন্ত সময়। তা আর শেষ হবে না। আল্লাহ্ কত দয়ালু যে অর্জনের জন্য ইহকাল তিনি স্থির করে দিয়েছেন। আমলের জীবনকাল সীমিত, আর প্রতিদান ভোগের জীবনটা অনন্তকালব্যাপী। তাই আমাদের দেখা উচিত, সীমিত এ ইহজীবনে আমরা অনন্ত আগামী জীবনের জন্য কী অগ্রায়ন করছি। কারণ, বান্দা তার জীবনের খুঁটিনাটি আমল’র কথা ভুলেও যাবে, আবার কৃত অপরাধ অস্বীকারও করবে। তার অস্বীকার প্রবণতার কারণে তার হাতে দেওয়া হবে আমলনামা। যেখানে লিপিবদ্ধ থাকবে তার সমস্ত কৃতকর্মের নথি।
আজকের আলোচ্য যে আয়াতে কারীমার আলোকে নির্ধারিত, তাতে পরকালীন পাথেয় চিন্তার নির্দেশনাই সুস্পষ্ট। আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনুল হাকীমের সুরা হাশর’র ১৮তম আয়াতে ইরশাদ করছেন, ‘হে আমার ওই সকল বান্দা, যাঁরা ঈমান এনেছো, তোমরা আল্লাহ্ তাআলাকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির দেখা উচিত যে, আগামীকালের জন্য সে কী আমল অগ্রে প্রেরণ করেছে। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। নিঃসন্দেহে, তোমরা যা (আমল, বড় কি ছোট, পুণ্য, কি পাপ) করে থাক, তা সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা সম্পূর্ণ অবহিত’।
আয়াতে সম্বোধিত হলেন নারীÑপুরুষ নির্বিশেষে সকল ঈমানদার ব্যক্তি। এ আয়াতে একটি নির্দেশনা দু’বার ঘোষিত। আয়াতের প্রারম্ভেও, আবার তার শেষভাগেও। তা হলো, ‘আল্লাহ্কে ভয় করো’। প্রতিটি মুমিন বান্দাই নিঃসন্দেহে বিশ্বাস রাখেন যে, ‘আল্লাহ্ অন্তর্যামী’। মনের গতি প্রকৃতি তিনি সম্পূর্ণ জানেন। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। তাই উক্ত নির্দেশনায় ধর্মের সমস্ত অনুশাসনই সক্রিয়। মাঝখানে রয়েছে, আগামীকাল’র জন্য কী সম্বল সঞ্চয় করা হচ্ছে, তা সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখা। আমল পেশ করা বা সঞ্চিত করার আগেই আল্লাহ্র ভয় মনে জাগরুক রাখা অতি প্রয়োজন। যাতে আমল ‘ইখলাস’ বা নিষ্ঠার সাথে অর্জিত হয়। দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ্য বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য মনে রেখে সম্পন্ন হলে তা যতই ভাল কাজ হোক, পারলৌকিক কল্যাণে এগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই, প্রারম্ভেই আল্লাহ্র ভয় অন্তরে না এলে নিষ্ঠা অর্জিত হবে না। ‘আল্লাহ্র ভয়’Ñ এর অপর নাম তাকওয়া। এটা না থাকলে পবিত্র কুরআনও তাকে পথ দেখাবে না। কেননা কুরআনের প্রধান পরিচিতি, ‘হুদান লিল মুত্তাকীন’। অপর আয়াতে আল্লাহ্র নির্দেশ, ‘তোমরা পথের সম্বল যোগাড় করো, অতঃপর সর্বোত্তম পাথেয় হল ‘তাকওয়া’। এটার ভিত্তিতে ‘আগামীর সম্বল’ আহরণ করা হলে, তা বিনষ্ট হবে না। দ্বিতীয়বার এ বাক্যের পুনরুক্তির কারণ, তোমাদের আমল যেন কৃত্রিম ও পরকালে প্রত্যাখ্যাত না হয়ে যায়। জেনে শুনে আল্লাহ্কে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টায় ঈমানও বরবাদ। তাই, মনে রাখা জরুরি যে, বান্দা কে কী আমল করছে, সবকিছু আল্লাহ্ খবর রাখেন। এরূপ তিনি অনেক জায়গায় সতর্ক বার্তার পুনরুল্লেখ করেছেন। যেমন, ‘ওয়ামাল্লাহু বিগাÑফিলিন আম্মা তা’মালূন। ‘অর্থাৎ’ তোমাদের আমল সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা গাফিল নন’।
আমাদের একথাও স্মর্তব্য যে, ইহকালে আমাদের কৃতকর্মসমূহ পরকালের প্রতিদান প্রত্যাশায়। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লিগাদিন’Ñঅর্থাৎ ‘আগামীকাল’ এর জন্য। এখানে পরকালকেই আগামীকাল বলা হয়েছে। এরমধ্যেও রয়েছে বিবিধ তাৎপর্য। পরকাল’র বিপরীতে পার্থিব জীবনের চলমান সময়কে আমরা বলি ‘ইহকাল’। তাই, পরকাল যদি ‘আগামীকাল’ শব্দে ব্যক্ত হয়, তবে এর বিপরীতে ইহকাল হয় আজ। আমরা যেদিন ইহজীবন শেষ করে চোখ বুঁজবো, তখনই শুরু হবে আগামীকাল বা পরকাল। যেহেতু, আমাদের এ জীবন নিঃশ্বাস বন্ধ হলেই শেষ, কাজেই তা আগামীকাল’র চেয়ে নিকটতর। মুফাসসিরগণ, এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যথাÑ এক. সমগ্র ইহকাল পরকালের তুলনায় অতি সংক্ষিপ্ত ও স্বল্প, যা একদিনেরও সমান নয়। অর্থাৎ আমাদের নিজ নিজ জীবনকালের হিসাবে হলেও কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের তুলনায় অতি অল্প। আর এ নশ্বর পৃথিবীর বয়স হিসাবেও মহাকাল বা হিসাবোত্তর অনন্তকালের তুলনায় এটি খুবই স্বল্প। দুই. পার্থিব জীবনের তুলনায় এ আখেরাত সুনিশ্চিত। আজকের দিন শেষ হলেই আগামীকাল যেরূপ সুনিশ্চিত, তেমনি ইহকাল শেষে পরকালের আগমনÑএটাও নিশ্চিত, অমোঘ সত্য, অবধারিত, অবশ্যম্ভাবী। তিন. এটা অতি নিকটবর্তী। বর্তমান’র সাথে এ নৈকট্য বুঝাতে একে ‘আগামীকাল’ বলা হয়েছে।
কিয়ামতের নিকটবর্তিতাকে আল্লাহ্ তাআলা খুবই গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। সুরা ক্বামার এ বিষয় দিয়েই শুরু হয়েছে যে, ‘ইক্বতারাবাতিস সাÑআতু’ অর্থাৎ কিয়ামত বা মহাপ্রলয় নিকটস্থ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ দু’ আঙ্গুল মুবারক একত্র করে দেখিয়ে বলেছেন, ‘আমি ও ক্বিয়ামত এ রকমই’। অর্থাৎ তিনি শেষ নবী, এটা শেষ যমানা। কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী আসবেন না। নবীজির আগমনকাল হতে সৃষ্টিকুল এ কিয়ামতের অপেক্ষায় রয়েছে। ক্বিয়ামত বা মহাপ্রলয়, যা কমবেশি প্রায় মানুষের কাছে অজানা, তা কুরআনÑসুন্নাহতে বর্ণিত সৃষ্টিকুল ধ্বংস হওয়ার ক্বিয়ামত। এটাতে সবাই নিশ্চুপ থাকে, অধিকাংশই এর সত্যতাকেও স্বীকার করে। কিছু আছে, যারা এটা নিয়েও উপহাস করে। এ অবিশ্বাসী, উদ্ধত লোকেরা প্রশ্নাসু দৃষ্টিও তোলে। যাদের কথা পাক কুরআনে মহান আল্লাহ্ তালা উদ্ধৃত করেছেন,‘ বরং মানুষ তার অনাগত কাল নিয়েও ধৃষ্টতা দেখাতে চায়, সে প্রশ্ন করে, কখন আসবে সে ক্বিয়ামতের দিন?’ সাথে সাথেই আল্লাহ্র বাণীতে উত্তরও আসে, ‘যখন দৃষ্টির বিভ্রম ঘটবে (হঠাৎ দৃষ্টি চমকিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে) ও চাঁদের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যাবে, আর সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। সেদিন মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলবে, ‘কোথায় পালানোর জায়গা’? এ কিয়ামতের ভয়াবহতার কথা পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সুরা হাজ’র শুরুতে লক্ষ্য করা যাক এর ভীতিকর অবস্থার একটু বর্ণনা, ‘হে মানবজাতি, তোমরা নিজেদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয় কিয়ামতের ভূকম্পন এক ভয়াবহ ব্যাপার! সেদিন তোমরা তা দেখবে, প্রত্যেক দুগ্ধদানকারিণী বিস্মৃত হবে তার দুধের শিশুটির কথাও, আর প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলা (তাৎক্ষণিক) গর্ভপাত করবে। মানুষকে দেখবে মাতলামি অবস্থায়, অথচ তারা নেশাও করেনি। বস্তুত আল্লাহ্র আযাব অত্যন্ত কঠিন’।
আরেকটি ক্বিয়ামত আপেক্ষিক। এটা একান্ত নিজের জন্য, যা অন্যে অনুভব করতে পারবে না। যেমন মৃত্যুর কষ্ট। এটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিয়ামত। হাদীস শরীফে আছে, যে মৃত্যুবরণ করে, তার কিয়ামত (নিজের কাছে) সংঘটিত হয়ে যায়। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থান কবর অর্থাৎ বরযখ। যা আখেরাতের প্রথম সোপান। এটা প্রতীক্ষালয়ের মত। এর পরবর্তী অবস্থান সর্বজনীন মহাপ্রলয় কিয়ামতোত্তর। কবর থেকে আর আমলের কোন সুযোগ নাই। এখানেই অর্জনের সুযোগ, যা পাওয়া যায়।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।