সুপ্রভাত ডেস্ক »
ইউক্রেন সংকট ভারতকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে কঠিন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কারণ নয়াদিল্লি তার পুরানো মিত্র রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চেষ্টা করছে ৷
ভারত সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দুটি ভোটে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে—একটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাব এবং অপরটি পদ্ধতিগত ভোট, যাতে ইউক্রেন বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনের আহ্বান জানানো হয়েছে ৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এখন কঠিন সময় যাচ্ছে, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে। দেশটির অস্ত্রের জোগানের একটি বড় অংশ আসে রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া রাশিয়া অতীতে সবসময় প্রয়োজনে ভারতের পাশে থেকেছে। এসব বিষয় ভারতের সাম্প্রতিক সিধান্তের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চীনকে মোকাবিলা করতে ভারতের পশ্চিমা মিত্রদের প্রয়োজন পড়বে। ইউক্রেন সংকটে তাই নিরপেক্ষ থাকা ভারতের জন্য কঠিন হবে।
“ভারতের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ যদি চীন হয়, বাস্তবতা হলো বেইজিংকে মোকাবিলা করার জন্য ভারতের রাশিয়া এবং পশ্চিম উভয়েরই প্রয়োজন। স্বল্প মেয়াদে আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা সরবরাহের প্রায় ৬৫ শতাংশের জন্যে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং দীর্ঘমেয়াদে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং এর উত্থান ঠেকাতে আমাদের পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন”, নয়া দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান হর্ষ পান্ত বলেন।
একদিকে বাইডেন প্রশাসন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা প্রস্তাবের ভোটের আগে একটি “শক্তিশালী যৌথ প্রতিক্রিয়ার” প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ভারতকে চাপ দিয়েছিল। অন্যদিকে নয়াদিল্লিতে রুশ দূতাবাস ভোটদানে বিরত থাকার পরে ভারতের “স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানকে” স্বাগত জানিয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকলেও, নয়াদিল্লি মস্কোকে দৃঢ় সমালোচনা করে বলেছে যে, কূটনীতি ও সংলাপের পথে ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই এবং জাতিসংঘের সকল সদস্যদের অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধার নীতি মেনে চলা উচিত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি ফোন কলে “অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করার” এবং “কূটনৈতিক আলোচনার পথে ফিরে আসার জন্য সব পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টার” আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু নয়াদিল্লির পক্ষে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। টি-৯০ ট্যাঙ্ক থেকে শুরু করে মিগ ও সুখোই ফাইটার জেট, একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে ইজারা দেওয়া একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং রাশিয়ান অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ভারতের সশস্ত্র বাহিনী। নয়াদিল্লিতে রাশিয়ার দূত রোমান বাবুশকিন সামরিক নির্ভরতার বিষয়টি তুলে ধরে ভারতের সমর্থনের আহ্বান জানান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “রাশিয়াই একমাত্র দেশ যেটি ভারতকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে এবং আমাদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী বিষয়”।
নয়াদিল্লির অন্য উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে—বর্তমান সংকট কি রাশিয়াকে চীনের কাছাকাছি ঠেলে দেবে? সে ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে বেইজিংকে মোকাবিলা করা আরও কঠিন করে তুলবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন আপাতত নয়াদিল্লির অবস্থানকে “অনিচ্ছা স্বত্তেও” মেনে নিয়েছে।
“ভারতের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। ভারত এবং আমাদের মূল্যবোধও এক। আমরা জানি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের একটি সম্পর্ক রয়েছে যা রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থেকে আলাদা। আমাদের তাতে কোনো সমস্যা নেই”, শুক্রবার ইউক্রেন সংকট ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন।
তবে কোয়াডের সদস্য হিসেবে ভারতের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন উঠবে। কারণ অন্য তিনটি সদস্য দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দিলেও ভারত বিরত থেকেছে। কোয়াড হলো ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের একটি জোট।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অবিলম্বে কোনো সমস্যা না হলেও ভারত রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে অস্ত্র আমদানি কমাতে বা এমনকি বন্ধ করার জন্য চাপের সম্মুখীন হতে পারে।
“মূল কথা হলো যে ইউক্রেনের যুদ্ধ নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনের সম্পর্কের একটি দিক উন্মোচিত করেছে, যেটা হলো রাশিয়া ইস্যুটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নিছক উপদ্রব হিসেবে বিবেচিত হবে না”, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান বলেন।
যদিও নয়াদিল্লি আপাতত নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে, ইউক্রেনের পরিস্থিতির অবনতি হলে ভারতের অবস্থান টলে যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
কুগেলম্যান বলেছেন, “এই বর্তমান সংকটে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান মূলত বড় জুয়ার মতো, কারণ রাশিয়ার বর্তমান আগ্রাসন শীতল যুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক হতে পারে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে”।
“কিন্তু আমি মনে করি না যে, ভারত তার অবস্থান শিগগিরই পরিবর্তন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রও সেটা মেনে নিয়েছে”।
তিনি বলেন যে, একটি ক্রমবর্ধমান ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে “ভারতের যে নিরপেক্ষ অবস্থান সেটা যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে, এবং দেশটি একটি শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে”।
সূত্র : ভয়েস অফ আমেরিকা