আড়াই ঘণ্টায় তৈরি হচ্ছে জিপিএইচের বিশ্বসেরা রড

ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ব্যবহার বৃষ্টি-হ্রদের পানি

ইস্পাত শিল্প

ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে ব্যবহার বৃষ্টি-হ্রদের পানি

ভূঁইয়া নজরুল »

বাইরে ভাঙাচোরা লোহার টুকরার স্তূপ। বিভিন্ন সাইজের এসব লোহার টুকরো থেকে মাত্র ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ও বিশ্বসেরা রড। ‘কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস’ পদ্ধতিতে লোহায় থাকা নানা অপদ্রব্য দূরীভূত করে ১১৫ টন স্ক্র্যাপ লোহা থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টন রড।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় ঢাকা-চট্টগ্রামের পাশে গড়ে উঠা জিপিএইচের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের পাশে বিভিন্ন সাইজের লোহার স্তূপ। চলছে সেসব লোহা পৃথকীকরণের কাজ। লোহাগুলোকে সাইজ অনুযায়ী নিয়ে আসা হচ্ছে বিভিন্ন চেম্বারে। সেসব চেম্বার থেকে যান্ত্রিক উপকরণের মাধ্যমে তা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গলানোর জন্য। ১৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এসব লোহাকে গলাতে সময় লাগছে ৪০ মিনিট। গলানো এসব লোহা একটি লেডারে (ট্যাংক) জমা করা হয়। গলানো লোহাগুলোর ট্যাংকটি ক্রেনের সাহায্যে ৫০ মিটার দূরে আগুনের মধ্যে রিফাইন করা হয়। আর তা করতে সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট।
রিফাইনের পর গলিত লোহাগুলো দিয়ে বিলেট (গলিত লোহার দণ্ড) তৈরি করা হয়। আর বিলেট তৈরি করতে সময় লাগে ৩৫ মিনিট। বিলেট তৈরি শেষ হলে তা চলে যায় স্টিল রোলিংয়ে, সেখানে চাহিদা অনুযায়ী রডের আকার দেয়া হয়। আর তা তৈরি করে সম্পূর্ণ ফিনিশড পণ্য বের হতে ৪০ মিনিট সময় নেয়। এই প্রক্রিয়ায় বের হচ্ছে বিশ্বমানের লোহা। সম্পূর্ণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া এই রডে মানুষের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

এ পদ্ধতিতে খরচও বেশি

জিপিএইচ যে পদ্ধতিতে বিশ্বমানের রড তৈরি করছে তাতে খরচ বেশি পড়ে। এ বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা শুধু দেশসেরা নয়, বিশ্ব সেরা রড প্রস্তুত করছি। আর বিশ্বসেরা রড তৈরি করতে খরচও বেশি পড়ে। তাই টনপ্রতি দামও অন্যান্য কোম্পানির রড থেকে বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।’
জিপিএইচ কর্তৃপক্ষ জানায়, কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস পদ্ধতিতে প্রতিটন রড তৈরি করতে অন্যান্য (ইন্ডাকশন ফার্নেস) পদ্ধতি থেকে ৪ হাজার ৯১৪ টাকা বেশি খরচ হয়। এজন্য অতিরিক্ত অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, লাইম, ডলো লাইম, ইলেকট্রোড প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হয়। কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস পদ্ধতিতে কেন রড প্রস্তুত করা হচ্ছে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা গুণগতভাবে সেরা পণ্য তৈরি করতে চাই। আর তাই সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।’

ক্ষতি হচ্ছে না পরিবেশের

রড তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পানির। কিন্তু এই পানির সংস্থান কোথা থেকে আসছে? সীতাকুণ্ড এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির অবস্থাও ভালো নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিপিএইচের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘আমরা পাহাড়ি এলাকায় লেক ( হ্রদ) তৈরি করেছি। সেই লেকে বৃষ্টির পানি ধারণ করে রাখি। এ পানি আমরা আমাদের কারখানায় ব্যবহার করি। আমরা কোনো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করি না। একইসাথে কারখানার ব্যবহৃত পানি রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে আবারো ব্যবহার করা হয়। ফলে কারখানা থেকে কোনো দূষিত পানি বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

উৎপাদন ক্ষমতা ও কর্মসংস্থান

২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে জিপিএইচ উৎপাদনে আসার পর গত বছর চীনে ১ লাখ ২০ হাজার টন বিলেট রপ্তানি করে। দেশের ইস্পাত শিল্পে তা বিস্ময়কর। এ বিষয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন,‘ আমরা দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করতে চাই। সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। দিনে সাড়ে তিন হাজার টন রড তৈরির সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে আমরা ২৬০০ টন উৎপাদন করছি।’

অপরদিকে এই কারখানায় কি সংখ্যক শ্রমিক কাজ করছে জানতে চাইলে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘প্রত্যক্ষভাবে চার হাজার ও পরোক্ষভাবে আট হাজারসহ মোট ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই কারখানায়।’

তিনি আরো বলেন, স্থানীয় যোগ্য লোকদের কর্মসংস্থানে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। এ পর্যন্ত এখানকার ২২৭ জনকে চাকরির সুযোগ দেয়া হয়েছে। একইসাথে এই এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা কমপ্লেক্স গড়ে তোলাসহ সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নেয়া হয়েছে।

শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে তিনি বলেন,‘ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের উৎপাদন বোনাস দেয়া হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জিপিএইচ, আবুল খায়ের, বিএসআরএম, কেএসআরএম। দেশে রডের চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।