আহমদ মমতাজ : ইতিহাস-ঐতিহ্যের সূত্রধর

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী »

আহমদ মমতাজ বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের এক বিশিষ্ট নাম। সাহিত্যের প্রায় সবক’টি শাখায় তার অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ দেখা যায়। তবে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি বেশ সপ্রতিভ ছিলেন। তাকে চিহ্নিত করা যায়, একজন একনিষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও পরিশ্রমী গবেষক হিসেবে। অনেকটা নিভৃতচারী ও সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্য¯ত নিবেদিতপ্রাণ এ লেখক চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে সাহিত্যে তার একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। তবে তার যে বিষয়টি আমাকে বেশি কাছে টানে, তা হলো- তার ইতিহাস- ঐতিহ্য প্রেম ও তৎসংশ্লিষ্ট লোকদের জীবনী রচনা। এ লক্ষে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহে নিষ্ঠাবান গবেষকের মতো তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়, একেবারে উৎস মূলে। তুলে এনেছেন ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক বিস্মৃতপ্রায় অজানা অধ্যায়। প্রচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসা সিক্ত এসব শেকড় ছোঁয়া লেখা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে।
আহমদ মমতাজের সঙ্গে আমার দেখা ২০০৫ সালে। আমি তখন আমার বিক্রির শীর্ষে থাকা বই ‘চট্টগ্রামঃ অতীত ও ঐতিহ্য’ বইটি লিখায় নিবিষ্টভাবে কাজ করছিলাম। এ সময়ে আমি প্রায়ই উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আবদুল করিম স্যারের বাসায় যেতাম আমার লিখার বিষয়ে পরামর্শ ও তথ্য- উপাত্তের শুদ্ধতা যাচাইয়ের নিমিত্তে। তখন সম্ভবত জুলাই মাস। আমি স্যারের ড্রইং রুমে বসা। লক্ষ করলাম, পায়জামা- পাঞ্জাবি পরিহিত কাঁধে চটের ব্যাগ ঝোলানো, চোখে চশমা পরা শ্যামলা গড়নের এক ভদ্রলোক রুমে প্রবেশ করে স্যারকে সালাম দিয়ে আমার পাশে বসলেন। সেখানেই আমাদের দু’জনার প্রথম পরিচয়। তারপর বিভিন্ন সাহিত্য সভা, বৈঠকে দেখা ও কথা হয় অনেক। আমি চট্টগ্রাম আর উনি ঢাকায় অবস্থান করার কারণে সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও মুঠোফোন, হোয়াটস অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারে লেখালেখি বিষয়ে আমাদের কথা যেন থামতোই না। প্রসঙ্গত ড. করিম স্যারের কথা বলতেই হয়। ড. করিম স্যার আমাদের দুজনকেই ভালোবাসতেন এবং ইতিহাস চর্চায় উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন, যদিও আমি রাজনীতি বিজ্ঞান ও মমতাজ ভাই বাংলার ছাত্র ছিলেন। মমতাজ ভাইয়ের সাথে স্যারের সখ্য আমারও অনেক আগের। ড. করিম স্যার শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকাকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রকে নিয়ে সুলতানী ও মোগল আমলে নির্মিত পুরাকীর্তির সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। আহমদ মমতাজ সেই টিমের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, যা তাকে ইতিহাস- ঐতিহ্য অনুসন্ধান ও গবেষণায় সম্পৃক্ত করে।
আহমদ মমতাজ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, ব্যাংকে চাকুরী, সাংবাদিকতা, মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। ছিলেন বাংলা একাডেমির ‘সহকারী পরিচালকও। তবে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আমার মনে হয়েছে, তার চেতনার গভীরে লুকিয়ে ছিল গভীর সংবেদনশীল স্বপ্ন বিলাসী এক লেখক মন, যা তাকে সৃষ্টির প্রসব বেদনায় প্রতিনিয়ত তাড়া করতো। এ তাড়না থেকেই তিনি বিভিন্ন জার্নাল, পত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখেছেন অনেক নিবন্ধ ও মৌলিক প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছে ১৮টি গ্রন্থ। আহমদ মমতাজ কাজ করেছেন এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ও বাংলা একাডেমির লোক সংস্কৃতি প্রকল্পে। তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্হমালা’ এর চট্টগ্রাম খণ্ডে অন্তর্ভূক্ত চট্টগ্রাম জেলার লোকজ সংস্কৃতি সম্পাদনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া (দ্বিতীয় সংস্করণ) এ ১৫টি লেখা ভুক্তি এবং ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ২০০৭ (নবম খণ্ড) এর লেখক- সংগ্রাহক হিসেবেও অবদান রাখেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস’ গ্রন্থে তার ১০টি যুদ্ধভিত্তিক লেখা স্থান পেয়েছে। তার ইতিহাস ও জীবনী নির্ভর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে – শমশের গাজী (২০১৩), মীরসরাইর ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি (২০০৬), বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী (২০১৫), চট্টগ্রামের সুফি সাধক ( প্রথম খণ্ড-২০০৪ এবং দ্বিতীয় খণ্ড- ২০০৬), খ্যাপা খুঁজে ফেরে (২০০৫), চট্টল মনীষা (২০১৩), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিঃ চট্টগ্রাম জেলা (২০১৮), মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা(২০১৮), চট্টগ্রামের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা (অগ্রন্হিত পাণ্ডুলিপি ), মালকা বানু ও মনু মিঞা (অগ্রন্হিত পাণ্ডুলিপি ), তালবাড়িয়া গণহত্যা( প্রকাশিতব্য) ইত্যাদি। তার আরও প্রবন্ধ- নিবন্ধ রয়েছে, যা আজও গ্রান্থিক রূপ পায়নি। এসবের অনেক আমার পড়া। এসব পড়ে তার ভেতরের লেখক প্রবণতার মূলক্ষেত্র হিসেবে তাকে ‘ইতিহাস- ঐতিহ্যের সূত্রধর’ হিসেবে চিহ্নিত করতে ইচ্ছে হয়। আজকাল অনেককেই যেনতেন প্রকারে অন্যের বই নকল করে লেখক বনে যেতে সচেষ্ট হতে দেখা যায়, যা সচেতন পাঠক ঠিকই ধরে ফেলেন, এসব লেখা বা বই আদৌ টেকে না এবং সময়ে আবর্জনার ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে আহমদ মমতাজ ব্যতিক্রম, তাকে দেখেছি কোনভাবে প্রভাবিত না হয়ে অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য সূত্রের সন্ধানে প্রয়োজনে সরাসরি ফিল্ড স্টাডির মাধ্যমে তার লেখনীকে এগিয়ে নিতে, যা আমারও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কাজটি বেশ পরিশ্রমসাপেক্ষ, যার জন্য অনেক ধৈর্যেরও প্রয়োজন হয়।এতে হয় কি, প্রকৃত পাঠক বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টালেই বুঝতে পারেন বইয়ের অভ্যন্তরে কী লুকিয়ে আছে, যা তার জানা দরকার !
আহমদ মমতাজ আমৃত্যু লেখালেখি করে গেছেন। লেখালেখির প্রতি তার দায়বদ্ধতার জায়গাটিও ছিলো বেশ সুদৃঢ় ও মজবুত। তার প্রতি লেখাতেই শ্রম, নিষ্ঠা ও মমত্ববোধের ছোঁয়া পাওয়া যায়। মৌলিক গবেষণা, উন্নত রচনা রীতি, যথেষ্ট যাচাই- বাচাই, শুদ্ধ চর্চার কারণে তার লেখা বইগুলো আসলেই নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনার দাবী রাখে।