হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ্ তাআলার প্রশংসা করতঃ আরম্ভ করছি, যিনি তাঁর বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির পয়গাম দিয়েছেন। তাঁর পবিত্রতা, যিনি অপবিত্র আক্বীদা বিশ্বাস থেকে আমাদের মুক্ত, পবিত্র রেখেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি আমাদের নিজ মাতৃভূমিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে ধর্মÑকর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। মুক্তমনে, স্বচ্ছন্দে সেই প্রভুর জন্য শোক্র’র সিজদা দেই।
আল্লাহ্ এক, অদ্বিতীয় উপাস্য। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। হায়াতÑমওত, রিয্কÑদওলত সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। আমাদের সত্য পথদ্রষ্টা, চূড়ান্ত মুক্তির নির্দেশক সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র সৃষ্ট, তাঁর বান্দা ও রাসূল। তাঁর রিসালত’র নিখাদ বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তিই মুক্তির মন্ত্রণা। তাঁর নির্দেশনা বর্জিত জীবনাচরণে মুক্তি নেই।
সৃষ্টিজগতের প্রতিটি প্রাণি নিজ ইচ্ছা আনন্দে বিচরণে সাচ্ছন্দ বোধ করে। বাধাÑবিপত্তি, শেকল পায়ে কেউ থাকতে চায় না। আমরা নিজেদের কৌতূহলে অনেক বণ্য প্রাণিদের, মুক্ত বিহঙ্গকে শেকলে, পিঞ্জরে বেঁধে রেখে পালনÑ পোষণ করি। যতই ভালো উপাদেয় খাবার দেয়া হোক, তাতে তাদের মনোতুষ্টি আসে না। এটা স্বাধীনতার পরিপন্থি, পরাধীনতা। একটা সময়ে বন্য প্রাণিদের মত মানুষকেও বেচা-কেনার জন্য মানুষেই হাটেবাজারে উঠাতো। ইসলাম ধর্মে দাসত্বের শৃঙ্খল হতে মানুষদের মুক্তি দেবার প্রণোদনা অদ্ভুত। বিভিন্ন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য গোলাম আযাদের বিধান কতই না মানবিক। কতল, কসম, যিহার ইত্যাদি কাফ্ফারায় দাস মুক্তির বিধান লক্ষণীয়। বন্দীত্ব ও পরাধীনতা সমার্থক। বনী ইসরাঈল গোত্র ফিরআউনের কবলে দুঃসহ জীবনযাপন করত। আল্লাহ্ তাদের মুক্ত করার জন্য একজন স্থিরপ্রতিজ্ঞ রাসূলকে দায়িত্ব দেন। মহান আল্লাহ্র ইরশাদ, ‘আর স্মরণ করুন, যখন মুসা (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা নিজেদের ওপর আল্লাহ্র অনুগ্রহের কথা স্মরণ রেখো, যখন তিনি তোমাদেরকে ফিরআউন সম্প্রদায়ের কবল হতে মুক্তি দিয়েছেন, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট রকম নির্যাতন করতো। আর তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদের যবাই করে (হত্যা) করতো। আর তোমাদের কন্যা সন্তানদের (সেবাদাসী বানানোর উদ্দেশে) জীবিত রাখতো। আর এ (মুক্তিদান)র মধ্যে নিহিত রয়েছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ হতে মহা অনুগ্রহ’। (১৪:৬) এ আয়াতের মধ্যে ফিরআউনের অমানবিক নির্যাতন হতে বনী ইসরাঈলের মুক্তিলাভ এবং স্বাধীন, স্বচ্ছন্দ জীবনলাভ করাকে পয়গম্বরের সাহায্যে ‘আল্লাহ্র অনুগ্রহ’ বা নে’মাত বলে উল্লেখ করা হয়। (এ অনুবাদে ‘খাযাইনুল ইরফান’ গ্রন্থ অনুঃসৃত) এ থেকে আরো বুঝা গেল, অত্যাচারী রাজা বাদশাহ্র পরাধীনতার শৃঙ্খল’র আরেক নাম আযাব, আর তা থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতা বিধাতার অনুগ্রহ। মহান এ কাজে আল্লাহ্ তাঁর পয়গম্বর পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ্র বান্দাকে অত্যাচারী শাসকের দুঃসহ অনাচার হতে মুক্তি দেয়া আল্লাহ্র কাছে পছন্দনীয়।
বনী ইসরাঈলের মুক্তির দিন স্মরণীয় রাখার উদ্দেশ্যে ইহুদীরা আশুরার রোযা পালন করত। তখন হুযূর (দ.) স্থির করলেন পয়গম্বরের মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহ্র ‘অনুগ্রহ’ প্রাপ্তির দিন উদযাপন করার অধিক হকদার পয়গম্বর হিসাবে সে আমিই। এ মর্মে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, ‘রাসূলুল্লাহ্ (দ.) হিজরত করে মদীনায় শুভাগমন করার পর দেখলেন, এখানকার ইহুদী সম্প্রদায় সেই দিন রোযা পালন করে। (উল্লেখ্য, দিনটি ছিল মুহাররামের দশম দিবস)। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞানা করেন। তখন তারা বলেন, এটা সেই দিন, যেদিন আল্লাহ্ ফিরআউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আর মুসা (আ.) কে নাজাত দিয়েছিলেন। ফলে তিনি সলিল সমাধির কবল থেকে মুক্তিলাভ করেন। (বলা বাহুল্য, তাঁর কারণেই আল্লাহ্ বনী ইসরাঈলকে নাজাত দান করলেন)। তাই, আমরা আল্লাহ্র নেয়ামতের শোকরানায় সেদিন রোযা পালন করে থাকি। তখন আল্লাহ্্র রাসূল ইরশাদ করলেন, ‘মুসা (আ.)র সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমিই অগ্রাধিকারী’। এরপর তিনিও সেই দিবসে রোযা রাখলেন এবং সাহাবীগণকে উক্ত তারিখে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন’। এ থেকে এটাও কি প্রতীয়মান হয় না, যে পরাধীনতা থেকে লাভের দিন উদযাপন করা, আল্লাহ্র শোকর করা তাঁর প্রিয়জনদের পছন্দনীয় আমল?
আজ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা এক নেয়ামত। এটা সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র দয়া অনুগ্রহ ছাড়া অর্জন করা যায় না। এ কারণে নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে আল্লাহ্র শোকরানা আদায় করা, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা জরুরি। নচেৎ তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। সাথে সাথে এটাও মনে রাখা জরুরি যে, স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। প্রত্যেক স্বাধীন মানুষের নিজ জীবনযাত্রায় ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার। দেশের কর্তব্য পালন ছাড়া জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অর্থহীন। দেশ, জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করার শপথ নিতে হবে এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
পার্থিব জীবনের অনিশ্চিত আয়ুষ্কালের পরাধীনতা শেকল আমাদের কাছে দুর্বিষহ। এটাও স্বাভাবিক। তবে প্রতিটি মুমিন নরÑনারীর একান্তচিত্তে বিশ্বাস করতে হবে, এরপরে আমাদের পরকালে যেতে হবে। যাওয়ার তারিখ যদিও নিশ্চিত নই। কিন্তু পরযাত্রা সুনিশ্চিত, অবশ্যাম্ভাবী। আর পরকালের সে অনন্ত জীবনেও আছে বেহেশত দোযখের কথা, আছে মুক্তি, শান্তির বিপরীত যুগপৎ শেকল পরা ও শাস্তিভোগের কথা। সেই মুক্তির ভাবনা থেকে নিজেকে ছুটি দেওয়া কি সঠিক সিদ্ধান্ত? সেখানেও তো আগুনের শেকলে নরকের অনন্ত বন্দি জীবন। আল্লাহ্ তাআলা বড়ই মেহেরবান, অতিশয় দয়ালু। তাই তাঁর দয়া, অনুগ্রহের মূর্তরূপ নবীকে পাঠিয়েছেন ‘রহমতুল্লিল আলামীন’ রূপে। রহমতুল্লিল আলামীন, খাতেমুন্নবিয়্যীন নবীর শাফাআতে কুবরাই হবে উম্মতের শেষ ভরসা। ইহজীবন ক্ষণস্থায়ী, পরজীবনই চিরস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পরকালে চিরস্থায়ী জীবনের মুক্তি ও আনন্দের, তাকে প্রাধান্য দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপনের চেষ্টা করা যে নেহায়েত জরুরি। অবিশ্বাস বা ভুলে থেকে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ঠেকানো যাবে না। বরাত’র অর্থ মুক্তি। শেষ নবী শফীউল মুযনিবীন’র উম্মতের পারলৌকিক মুক্তির বারতা নিয়ে দুয়ারে শবে বরাত। এ রাতে ইহলৌকিক, পার্থিব জগতেরও অনেক কিছু বণ্টন হয়। এ জন্য বিশ্ব মুসলিম ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে রাতটি বিনিদ্র অতিবাহিত করেন। আল্লাহ্র কাছে ইহ-পরকালের সমৃদ্ধি, মুক্তি কামনা করেন। পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে চাওয়া তিনি পছন্দ করেন। সুরা দুখান’র প্রারম্ভে একটি রাতের কথা আছে, ‘যাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে ফায়সালা স্থির হয়’। হযরত ইকরামাসহ কতেক মুফাস্সিরীনের মতে এটি হচ্ছে বরাতের রাত। যথা, ক্ষমার রাত, অনুগ্রহের রাত, তাওবা, অনুশোচনার রাত, যিক্র ও সালাতের রাত, সদকা ও খায়রাতের রাত। এ রাতে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি হয়, বিপদ সরে যায়, আশা পূর্ণ হয়, দুআ কবুল হয়, বহু আকাক্সক্ষা পূরণ হয়-যদি বিশ্বাস ও একাগ্রতায় বান্দা প্রার্থনা করে।
এ রাতের ইবাদত-বন্দেগী, তাওবা ইস্তিগফার কবুল হলে মুমিন নর-নারী জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ করে। মুমিন জননী হযরত আয়েশা (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেন, শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার আসমানে নিজ তাজাল্লীর অবতারণ করেন এবং এ রাতে বনু কাল্ব গোত্রের বকরীগুলোর পশম সংখ্যার অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন। (মিশকাত) ক্ষমাপ্রাপ্ত বান্দারা হবে জাহান্নাম থেকে মুক্ত। সে মুক্তির তৃপ্তি, আনন্দের বর্ণনা অসাধ্য। তবে, খালিস অন্তরে তাওবা করতঃ এর ওপর অটল থাকতে হবে । এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।