হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন জাল্লা শানুহু’র জন্য সমস্ত প্রশংসা গুণগান, যাঁর নির্দেশেই যুগ পরিক্রমার ধারা নিরবচ্ছিন্ন রয়েছে। তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করি, যিনি ক্ষয়, লয় ও নিঃশেষ হওয়া থেকে পবিত্র, চিরন্তন, চিরঞ্জীব। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের জন্য তাঁর বন্দেগীর নিটোল আদর্শরূপে আখেরী নবীর পবিত্র জীবন ধারার অনুপম প্রতিচ্ছবি উপহার দিয়েছেন।
আল্লাহ্র একত্ব ঘোষণা করি, যাঁর কোন শরীক নাই, নাই কোন সমকক্ষ। তাঁর ইচ্ছাতেই আমাদের সৃজন, পালন, জীবন, মরণÑসবকিছুই সংঘটিত হয়। রবিউল আউয়াল শরীফের মহান বর, ইনসানিয়্যতে রাহ্বর সায়্যিদুনা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল।
মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তাআলার অবিনশ্বর সত্তা স্থানÑকালের গ-ি মুক্ত। তিনি অনাদি, অনন্ত, শাশ্বত, চিরন্তন। তিনি ছাড়া বাকি সবকিছু তাঁরই সৃষ্টি। সৃষ্টির যেমন শুরু আছে, আবার শেষও আছে। নশ্বর এ পৃথিবী তাঁর ইচ্ছায় সৃজিত, বিদ্যমানÑআবার তাঁর নির্দেশে ধ্বংসশীল। আল্লাহর ইচ্ছায় সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করে, তাঁরই ইচ্ছায় আবার এর বিলোপ ঘটে। জীবনÑমৃত্যু সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, সৃষ্টির নিয়ম। ¯্রষ্টার নিয়মাধীন তাঁর সকল সৃষ্টি। সৃষ্টির নিয়মে আমাদের প্রিয়নবীর যেমন এ মাসে শুভ জন্ম তথা বেলাদত শরীফ, আল্লাহ্র ইচ্ছায় তাঁরই পরিকল্পনা মোতাবেক এ পবিত্র মাসেই তাঁর তিরোধানও। নবীজির বাণীই রয়েছে যে, ‘আমার এ হায়াত (ইহজীবন) ও তোমাদের জন্য উত্তম, আমার তিরোধান (লোকান্তরে যাওয়া) ও তোমাদের জন্য মঙ্গল’। উহুদের যুদ্ধে অতর্কিতে পরিস্থিতি পাল্টে গেলে মুসলমানরা কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় এক পর্যায়ে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ও আহত হন, তাঁর একটি দাঁত মুবারক শহীদ হলে শয়তানের রটনায় গুজব চাউর হয়ে পড়ে যে, মুহাম্মদ (দ.) শহীদ হয়ে গেছেন। এতে তাঁর সাহাবীদের মনোবল ভেঙে পড়ে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়, প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার কারণে স্বয়ং নবীজি তাঁদেরকে তিরস্কার করলে তাঁরা বললেন, আপনার শাহাদতের গুজব আমাদের বিপর্যস্ত করে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে আয়াত নাযিল হয়। যাতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মদ তো একজন রাসূলই, তাঁর পূর্বে আরো অনেক রাসূল বিগত হয়েছেন। তা হলে, যদি তিনি ওয়াফাত বরণ করেন বা শহীদও হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদ্ধাবণ করবে? আর যে উল্টো পায়ে ফিরে যাবে, সে আল্লাহ্র কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না’। (৩:১৪৪) সুরা যুমার’র অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সন্দেহ নেই যে, আপনিও ওয়াফাত বরণ করবেন আর তাদেরকেও মরতেই হবে’। (আয়াত-৩০) এ আয়াত রাসূলÑবিদ্বেষী কাফেরদের খ-নে অবতীর্ণ। যারা নবীজির ওয়াফাতের দিকে চেয়ে অপেক্ষায় থাকত। আয়াতে তাদের নির্বোধ মানসিকতার জবাবে বলা হয়েছে, নিজেরা মরণশীল হয়েও অন্যের মরণপ্রতীক্ষা হাস্যকর। নশ্বর পৃথিবীর মাঝে ব্যক্তির জীবন আরো সংক্ষিপ্ত, অধিকতর ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু, নশ্বর জীবনে কে ক’বছর ছিল বা থাকবে, তা দিয়ে জীবনের মূল্যায়ন অবান্তর। ব্যক্তির কর্মের পরিধি, সার্থকতা, আদর্শের স্থায়িত্বÑএসবই বিবেচ্য। প্রিয়নবী সৃষ্টিতে অতুলনীয়, সাফল্যে তাঁর তুল্য বিশ্বের ইতিহাসে কেউ নন। তিনি প্রথম সৃষ্টি, নূরের সৃজন, বরং ¯্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের প্রেরণা। তাঁর ইতিহাসও যেমন ব্যতিক্রম তেমনি তাঁর তিরোধানও। আলমে দুনিয়ায় কি আলমে বরযখে অভিন্ন হায়াতে সশরীরে জীবিত। তাই, তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, তিনি হায়াতুন্নবী। আমাদের প্রায় মসজিদের মিম্বরে মিম্বরে শোনা যায় ইবনে নাবাতা কৃত খুৎবা। উচ্চমানের সাহিত্য গুণ ছাড়াও ছত্রে ছত্রে এর তাকওয়ার গুরুত্ব উচ্চকিত। তাই, এটি যুগযুগ ধরে অভাবিতরূপে গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে ঈর্ষণীয় অবস্থান নিয়ে জনপ্রিয়। এ সংখ্যার বক্তব্য অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী, মর্মস্পর্শী, চিত্তাকর্ষক। এর চৌম্বিক অংশটুকু তাই সাধারণ পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার গরজ অন্তরে অনুভূত হয়েছে।
হযরত আনাস বিন মালেক ও হযরত জাবের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা)’র বর্ণনা মতে, জাহেরী হায়াতের অন্তিম রোগে আল্লাহর রাসূল সফর মাসের ২৭ তারিখ থেকে শয্যাগত হন। এর প্রকোপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। যা মাহে রবিউল আউয়ালের বারো তারিখ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। রাসূলে পাক যখন অন্তিম আহ্বান অনুভব করলেন, তখন হযরত বেলাল (রাদ্বি.) কে নির্দেশ দিলেন সবাইকে আহ্বান জানাতে। মসজিদে নবভী শরীফে সাহাবায়ে কেরাম জমায়েত হলে আল্লাহর রাসূল তাঁদের উদ্দেশে এক মর্মস্পর্শী এবং উপদেশমূলক সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। যা শুনে উপস্থিত সকলের অশ্রুতে চোখ ভরে গেল। সেই খুৎবায় ছিল বেদনা বিধুর বিচ্ছেদের ইঙ্গিত, বিরহের ব্যথাভরা প্রাণস্পর্শী আবেদন। উপস্থিত সকলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এরপর তিনি কম্পিত দেহে মিম্বর হতে অবতরণ করলেন।
নবীগৃহের পবিত্র সদস্য এবং সাহাবায়ে রাসূলের একান্ত অনুরোধে এখান থেকে তিনি মুমিন জননী সায়্যিদা আয়েশা (রাদ্বি.)র হুজরায় অবস্থান নেন। নির্ধারিত সময়ে আল্লাহ্র নির্দেশে মালাকুল মাওত আয্রাঈল (আ.) সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁর এ আগমন হয় অতি সুন্দর সুরতে। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দরজায় উপস্থিত হন। তিনবার সালাম আরয করলেন। এরপর অনুমতি প্রার্থনা করলেন। (নবীর দরবারের আদব এ যে, ফেরেশতারও আসার জন্য অনুমতি প্রয়োজন হয়)। সালামের উত্তর দিয়ে নবীজি ¯েœহের দুলালীÑফাতেমা (রাদ্বি.) কে দুয়ারে আগন্তুক কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উঁকি দিয়ে দেখলেন, ভয়ানক সুরতের একজনকে। নবীজি বললেন, ‘ইনি মালাকুল মাওত’। অনুমতি দিলে আযরাঈল (আ.) প্রবেশ করে তাঁর অভিপ্রায় নিবেদন করলেন। নবীজি বললেন ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, জিবরাঈল (আ.) আসুক। এর কয়েক মুহূর্ত পরেই আসলেন জিবরাঈল। তিনিও সালাম আরজ করলেন। এবার প্রিয়নবী ইরশাদ করলেন, ‘জিবরাঈল, আযরাঈল কবযে রূহ’র অনুমতি চাইছেন’। তখন জিবরাঈল আল্লাহর ইচ্ছার কথাই ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনার প্রভু আপনার জন্য উদগ্রীব। হুর গেলমান আপনার জন্য অধীর অপেক্ষায়। আল্লাহ্ আপনার জন্য সালামের তোহ্ফা প্রেরণ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের পর নবীজি জানতে চাইলেন, ভাই জিবরাঈল, আমি দৃশ্যের অন্তরাল হলেও পরে আমার উম্মতের রক্ষায় কে থাকল? তখন জিবরাঈল (আ.) আরজ করলেন, ‘ হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রভু আপনাকে সালাম জানিয়ে ইরশাদ করেছেন, আমার হাবীবকে জানিয়ে দিও, আমিই হবো তাদের যিম্মাদার, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিজেই নিলাম। আমি আমার প্রভুত্বের মর্যাদার শপথ, স্বীয় মহত্বের শপথ করে বলছি, আমি আমার হাবীব (দ.)র উম্মতের বিষয়ে তাঁর দু’নয়ন জুড়িয়ে শীতল করে দেব। যতক্ষণ না আমার হাবীব মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর উম্মতসহকারে জান্নাতে প্রবেশ করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাকি সকল উম্মতের জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ। তাঁর মহান কিতাবে ‘ওয়ালা সাওফা ইউ’ত্বীকা রাব্বুকা ফাতা কথাটি কি নাযিল করা হয়নি? (অর্থাৎ অচিরেই আপনার প্রভু আপনাকে এতটাই দান করবেন যে, তাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন)। এরপর নবীজি সন্তুষ্টচিত্তে বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন আমার আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়েছে, আর ওয়াফাতের জন্য এখন চিত্ত প্রশান্ত হয়েছে। একজন উম্মতও দোযখে থাকলে আমি স্বস্তি পাবো না’।
আসমানী জগতে নবীজির ওয়াফাতে ঘটেছিল অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি। একই গ্রন্থে বর্ণিত তথ্য এ যে, ‘অতঃপর নবীজির রূহ মুবারক সাময়িকভাবে দেহান্তর করা হল। তারিখ ছিল বার রবিউল আউয়াল, সোমবার। সমাহিত হলেন বুধবার। লোকান্তর হওয়ার দিন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ‘রূহে মুস্তফা’ কে অভ্যর্থনা জানাতে দয়াময় প্রভুর ‘নূরে রহমানী’ জাহির করা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঊর্ধ্ব জগৎসমূহ দোলায়িত হতে থাকে। আর্শে ইলাহী প্রকম্পিত হয়। বিশিষ্ট ফেরেশতারা সম্ভ্রমে সারিবদ্ধ হয়ে যান। তাঁরা জানতে চান, ‘ইলাহী, কিয়ামত কি সংঘটিত হয়ে গেল’? বলা হল, ‘না, বরং আমার হাবীব লোকান্তরিত হয়েছেন, যিনি না হলে আমি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতাম না। তিনি আমার কাছে আসছেন।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।