সুপ্রভাত ডেস্ক »
জুলাই আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে ছয় সমন্বয়ককে হত্যা করা হবে বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশ ছিল। তৎকালীন ডিবি কর্মকর্তারা এমনটিই জানিয়েছেন বলে নিজের জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এ কথা উল্লেখ করেন তিনি। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন এই উপদেষ্টা। ১৯তম সাক্ষী হিসেবে তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
জবানবন্দির একপর্যায়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, গত বছরের ২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদারসহ আমাকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকেও আনা হয়। পরদিন সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও তুলে আনা হয়। আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য সেখানে আমাদের চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি বলে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়।
তিনি বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনুর রশীদ (ডিবি হারুন) ও রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপসহ ভয়ভীতি দেখানো হয়। আমাদের বারবার বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তুলে আনা হয়েছে। একইসঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরো বলে যে, তারা দয়া করে আমাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।
এই সাক্ষী বলেন, নিজেদের লিখিত একটি বক্তব্য জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে পাঠ করায় ডিবি। পরে সেটি মোবাইলে ভিডিও করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকায় আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ওই ভিডিও বার্তা জোরপূর্বক নেওয়া হয়েছিল বলে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেই। একইসঙ্গে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে এক দফা কর্মসূচি ও অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করি। ওই কর্মসূচিতে দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেন।
এছাড়া ৫ আগস্ট ভোর থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি পালনের জন্য সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করেন সাধারণ জনগণ। আমি, সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও সমন্বয়ক মোয়াজ্জেম হোসেন চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করি। তখন আমরা দেখতে পাই যে, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা নাজিম উদ্দিন রোডসহ চানখারপুল এলাকায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। তখন বেলা আনুমানিক ১১টা। চানখারপুল এলাকায় সেদিন আমরা ৪০০-৫০০ আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলাম। পুলিশের গুলিতে একের পর এক আন্দোলনকারীদের আহত হতে দেখতে পাই। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপসহ শর্টগান-চাইনিজ রাইফেলে গুলি করে। আমার সামনে পুলিশের গুলিতে দুজন আন্দোলনকারী নিহত হন। পরবর্তীতে জানতে পারি ওই দিন চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুনসহ ছয়জন নিহত হন।
এসব হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ডিএমপির সাবেক ম কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সরাসরি জড়িতদের দায়ী করেন আসিফ মাহমুদ।