অজয় দাশগুপ্ত »
দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের বালক বেলা। স্বাধীনতার পর পর শুরু হয় আমাদের তারুণ্য। তখন কী আর এত কিছু বুঝতাম বা জানতাম? সে সময়কালে বিনোদন মানে একটা সাদাকালো টিভি বাক্স আর বাংলা সিনেমা। সাদাকালো বাংলা সিনেমার সোনালী জগত তখন। টিকেটের লম্বা লাইন আগের রাতে গিয়ে ঠিক রেখে আসা কিংবা কালোবাজারে চড়াদামে টিকেট কিনে সিনেমা দেখা, মাঝখানে বিরতিতে কাঁচের বোতলে ফানটা আর চানাচুর সব স্বপ্নের মতো। সে স্বপ্নের সময়কালে সদ্যস্বাধীন দেশে নির্মিত হয়েছিল ‘ওরা ১১ জন’, ‘বাঘা বাঙালি’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামের ছায়াছবি। সিনেমার মান কেমন ছিল সে তর্ক মুখ্য না, মূল বিষয় ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট। ঠিক সে সময় খান আতাউর রহমান আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিলেন এক বিতর্ক। সে সময় না বুঝলেও এখন স্পষ্ট বুঝি কী ছিল নেপথ্যে।
খান আতাউর রহমান নিঃসন্দেহে এক গুণী প্রতিভা। গানে সুরে ছায়াছবি নির্মাণে তার ভূমিকা অবিসংবাদিত। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে ব্যক্তিজীবনে তার সন্দেহময়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার নির্মমভাবে নিহত হবার পর বিপথগামী সেনা অফিসারদের জন্য তার দরদ উথলে উঠেছিল। ছুটে গিয়ে বাংলাদেশ বেতারে গান লিখে সুর দিয়ে প্রচার করলেন জাতীয়তাবিরোধী বিশেষত বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী গান। সে সবের বাইরেও আজ যদি আমরা পেছন ফিরে দেখি দেখব খান আতার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বলে পরিচিত ছবি ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি মূলত উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সে সময়কালে মানুষের মনে নানা ধরনের সন্দেহ আর আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারের জন্য এমন একটা নামের সিনেমা দরকার ছিল বৈকি! তখন একটি বিশৃঙ্খল দেশ ও সমাজকে বঙ্গবন্ধু ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনছিলেন। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অস্ত্র সমর্পণ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দেশ গঠনে। সে সময় হঠাৎ খান আতার মনে হলো ‘মুক্তিযোদ্ধারা অমানুষ’! তাদের ‘মানুষ’ করতে হবে।
কিন্তু কী মুশকিল তার একবারও মনে হলো না রাজাকার, দালাল, আত্মগোপন করে থাকা খুনিদের মানুষ হয়ে ওঠা দরকার। জাতিকে জানানো হলো মুক্তিযোদ্ধাদের আবার মানুষ হতে হবে।
এখন তো মনে হয় সংস্কৃতির এসব কাজেই লুকিয়ে ছিল আজকের এই অধঃপতন। কিছু গানের কথা শুনলেও আপনি টের পাবেন তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধিতা। ‘দাম দিয়ে কিনেছি’, বাংলা গানটি আপাত সরল মনে হলেও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সব শক্তিকে কিন্তু এক ধরনের বাতিল করার খায়েশ ছিল গানে। বলাবাহুল্য এই শক্তি ভারত-রাশিয়াসহ আমাদের মিত্রশক্তি। আপনি খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন কোনো গানেই কিন্তু একটিবারের জন্যও বেগম রোকেয়া-প্রীতিলতা কিংবা সূর্য সেনের কথা আসেনি। অথচ অবলীলায় ঈশা খাঁর নাম এসেছে। ঈশা খাঁ কে? সুবেদার ফার্সি ভাষী এক কঠিন শাসক। যার কাজ ছিল বাংলা-বাঙালি দমন। সে মানুষটি কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে গানে এলেন, এল না বাংলাভাষী আমাদের স্বজন পূর্বপুরুষ বা নারীরা। এরপর আরো আছে। জেমস আমার খুব প্রিয় একজন গায়ক। স্বনামধন্য প্রতিভা। গানের কথা বা গানের কথায় ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ নন। গানপাগল এই মানুষটিকে দিয়ে গাওয়ানো আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, গানটি শ্রুতিমধুর জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানে একবারের জন্যও শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম উচ্চারিত হয়নি। গান গাওয়ার অপরাধে সুরের দায়ে শহীদ মানুষটিকে বাদ দিয়ে কত নাম! ‘শহীদ জিয়া’র কথাও এসেছে সেখানে। কে যে শহীদ আর কে গাজী সব হিসেব তখনই গোল পাকিয়ে গেছে।
আমার মতো আমজনতাও বুঝতে পারি এরপর আর কেউ এসব বিষয় ঠিক করার কথা ভাবেনি। আওয়ামী লীগ এখন যদি বলে তারা ইতিহাস বিকৃতি রোধ করতে পেরেছে তা এখন হাস্যকর শোনাবে। গত তিনবারের দেশ শাসনে তারা কোনো বিষয়ে সংস্কার করে জাতিকে শুদ্ধ করতে পারেনি। পারেনি জট খুলতে। উল্টো শাহবাগের মতো জমাট আন্দোলনকে তারা হালকা করে তোলায় যুবশক্তির বিশ্বাস টাল খেয়েছে তাদের কারণে। আজ আমরা কী দেখছি? ভুল জানতে জানতে, ভুল শিখতে শিখতে সংস্কৃতিও তার শক্তি হারিয়ে দুর্বল। এতটাই যে সে আর রুখে দাঁড়াতে পারে না। ভুলে গেছে তার ভেতরের তেজ। অথচ এরশাদ ও জোট সরকারের আমলে সংস্কৃতি বারবার প্রমাণ করেছিল তাকে চোখ রাঙানোর শক্তি নাই। এখন ধর্ম-অধর্মের এক অসম লড়াই চলছে সমাজে। বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল ধর্মভীরু। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই কোনো না কোনোভাবে ধর্মের গ-িতে বাঁধা। কিন্তু সে সময় এমন বিদ্বেষ প্রসূত বক্তব্য বা আচরণ দেখা যেত না। যে সমস্ত স্থাপনাগুলো কেউ কোনোদিন ভাঙা দূরে থাক, ছুঁয়ে দেখার চিন্তাও করেনি- সেগুলো এখন কোপানলের শিকার।
আমরা কিন্তু এটাও দেখছি আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দল দেশ শাসনে। তার কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মর্যাদা ও গৌরবে আসীন। বিরোধী দল বলতে কিছু নাই। বিএনপি-জামাতও প্রকাশ্যে কোথাও নাই। তারপরও একতরফা শাসনের বেড়ি ভেঙে জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়েছে। একই এলাকায় সম্প্রতি কোপানলের শিকার হয়েছে বাঘা যতীনের ভাস্কর্য। ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে স্বদেশের বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধের স্তম্ভ কিছুই বাদ পড়ছে না। এই অবনতি এই বিদ্বেষ আর হিংসা কি আওয়ামী লীগ ঠেকাতে পারবে? একটা কথা মানতেই হবে, জোর করে কোনো অপশক্তিকে সাময়িকভাবে দমানো যায় বটে তাকে নির্মূল করা যায় না। আজকের সমাজ ও দেশের দিকে তাকালে এটা মনে করার কারণ আছে সামনের দিনগুলো ভাল হতে পারে না। আর যে খারাপের নমুনা দেখা যাচ্ছে তার ধারাবাহিকতা মূলত একটি জাতির আত্মহননের সামিল। একথা অগ্রিম বলে দিতে পারি তা যদি হয়ও কান্নার বা ঘুরে দাঁড়ানোর লোকজনও পাওয়া যাবে না। ফিরে আসি এই আলোচনা শুরুর কথাগুলো দিয়ে। শেষবার যদি উদ্যোগ ও চেষ্টা করা না হয় এবং তা না হলে আন্তরিকভাবে বাঙালি আর বাঙালি থাকতে পারবে না।
আমরা যারা দেশের বাইরে থেকে বলি কিংবা লিখি অনেকে মনে করেন আমরা নিরাপদ বলয়ে থেকে তা করি। আপনারা হয়তো জানেন না দুনিয়ার কোনো দেশেই বাঙালি না আছে স্বস্তিতে, না অবাধ নিরাপত্তায়। দেশ ভালো না থাকলে বাংলাদেশের কেউ কোথাও ভালো থাকে না। ব্রতচারী গানে গুরুসদয় দত্তের লেখায় ছিল: কায়মনে বাঙালি হ।
আমাদের একটাই প্রত্যাশা- আবার সবাই বাঙালি হ। তাতেই মুক্তি।
লেখক : কলামিস্ট