আহমেদ মুনির <<
আপনার মৃত্যুর শোক লেখন আমাকে লিখতে হবে কখনো ভাবিনি। এ তো একদিক থেকে ভারী খাটিয়া কাঁধে নেওয়ার মতো। ২০০৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর সেই অভিজ্ঞতা একবার হয়েছিল আমার। যতটুকু পথ হেঁটেছি যন্ত্রণায় নুয়ে পড়েছি। কাউকে ছেড়ে আসা তো বাস্তবিকই এমন বেদনার।
আমাদের ছোট শহরের, ছোট পত্রিকার তুলনায় আপনার খ্যাতির ওজন বেশিই ছিল। তাই চট্টগ্রামে সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় আপনি সম্পাদক হয়ে আসার পর দূরে দূরে থেকেছি। সেই দূরত্ব আপনি প্রথম কয়েক দিনের মাথায় ঘুচিয়ে দিলেন। কাছে ডেকে কথা বললেন। কাজের কথা ছাপিয়ে আমাদের আলাপ বারবারই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা ভাসানীকে ঘিরে ঘুরপাক খেত। কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে নানা ছবি তৈরি হতো। হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে নোট নিচ্ছেন ছিপছিপে সুদর্শন তরুণ সাংবাদিক। আপনাকে এভাবেই কল্পনা করতাম। আমার প্রথম সম্পাদক ছিলেন আপনি। স্যার বলে সম্বোধন করায় আপনি কুণ্ঠিত হয়ে কাছে নিয়ে বসিয়েছিলেন। অপরিচয়ের আড়ষ্টতা কেটে যেতেই আপনার কামরায় ঘন ঘন ডাক পড়ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা শুনতে হতো আমাকে। কাজের অজুহাতও দিতে পারতাম না। কেউ এসে পড়লে নিস্তার মিলত।
আপনাকে ঘিরে আমাদের অনেকেরই একটা মুগ্ধতা ছিল। কেন, সেটা বলি। ২০০৩ সাল থেকে ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে আপনি পাশ্চাত্য পোশাক ছেড়ে সেলাইবিহীন কাপড় পরা শুরু করলেন। এরপর ২০০৮ সালে হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদ করে ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাতন্ত্রের নিন্দা জানিয়ে সরকারি সংবাদ সংস্থার চাকরি ছাড়লেন। দুটো ঘটনা দুই রকম। কিন্তু ভীষণ মিল আছে। প্রথম ঘটনা একটি দুর্বল জাতির ওপর পরাক্রমশালী সবল রাষ্ট্রশক্তির হামলা। দ্বিতীয়টি মত প্রকাশের কারণে একজন নিরীহ শিক্ষকের ওপর ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির হামলা। দুটোই দুর্বলের ওপর সবলের পীড়ন। আপনি সারা জীবন এই পীড়নেরই প্রতিবাদ করে গেছেন। কোনো কোনো স্থাপনা আছে, যা আমাদের মনন ও চিন্তায় অধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন শহীদ মিনার। আপনি আমাদের কাছে তেমনই জীবন্ত এক মিনার ছিলেন। যাকে দেখে মতো হতো প্রতিবাদের জন্য উচ্চকিত হওয়ার দরকার নেই, প্রচারের আলোয় থাকাও অনাবশ্যক। কেবল প্রয়োজন নিজের অবস্থানে মিনারের মতো অটল দাঁড়িয়ে থাকা।
কত বিচিত্র শ্রেণি-পেশার মানুষ আপনার জন্য শোকাকুল হয়েছেন ভেবে অবাক লাগে। ফেসবুকে আমার এক বন্ধুর ছবিতে দেখলাম পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়ের কোনো এক আন্দোলনে শামিল হয়েছেন আপনি। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কী আপ্রাণ চেষ্টা ছিল আপনার। সে জন্য আপনার গবেষণা, লেখালেখিতে সময় কমেছে। আরও অনেক কিছু করে যাওয়া হয়নি। তবু আপনি কখনো আফসোস করেননি।
কত লোকেই নিজেকে নিজের উচ্চতার চেয়ে বড় করে দেখে। কিন্তু আপনাকে তেমনটা করতে দেখিনি কখনো। নিজের পোশাক নিয়েও রসিকতা করতে ছাড়েননি। একবার খুব উত্তেজিত হয়ে আমাকে কক্ষে ডেকেছিলেন। বললেন, একটা নামি হাসপাতালে গেছেন, অনেক বলেও কোনো চিকিৎসক, নার্স বা কর্মকর্তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলেন না। এক কোণে ওরা আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখল। এই বিবরণ দিতে দিতে হেসে বললেন, আরে একজন এমন অদ্ভুত পোশাক পরে আছে, সেটাও তো খেয়াল করতে পারে!
তরুণেরা কী লিখছে, কী ভাবছে তা নিয়েও আপনার গভীর আগ্রহ ছিল। একটা ঘটনা মনে এল। একবার অফিসের নিচে চেরাগী পাহাড়ের রকে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আপনি গাড়ি থেকে নেমে একবার সে দৃশ্য দেখে আবার অফিসে উঠে গেলেন। বুক ধরাস করে উঠল। কাজের সময় আড্ডা দিচ্ছি বলে নিশ্চয় কপালে আজ খারাপ কিছু আছে। দ্রুত অফিসে ফিরতেই আপনার কক্ষে ডাক পড়ল। দুরুদুরু বুকে হাজির হতেই বললেন, ‘তোমাদের ওই আড্ডায় আমি গেলে অসুবিধা আছে? অবশ্য তাতে লোক জমে যাবে। তোমরা না হয় আমার বাসায়ই এসো।’
এমন অজস্র ঘটনার কথা মনে পড়ছে আজ। আপনার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি তা কি করে ভুলি? আমাদের প্রথম সন্তান জন্মের আগে আপনি চাকরি ছেড়েছেন। কিন্তু ভোলেননি। বাবা হওয়ায় চিঠি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন আমাকে। কী আশ্চর্য জানেন, পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে দুই দিন আগে সেই চিঠিখানা খুঁজে পেলাম। আমার স্ত্রীকে দেখিয়ে বলেছিলাম, আমার কাছে এর অনেক মূল্য। আর ওই চিঠিটা ছিল আমার কাছে হাতে লেখা কারও শেষ চিঠি। আপনি লিখেছিলেন-
স্নেহাস্পদেষু,
কন্যার পিতা হওয়ার জন্য তোমাকে অশেষ অভিনন্দন। মেয়ের মাকে আরও বেশি। কারণ ত্যাগ ও কৃতিত্ব তোমার চেয়ে তার হাজার গুণ বেশি।প্রথম কন্যাসন্তানের জনকজননী হওয়া খুবই সৌভাগ্যের কথা। বাচ্চার কি নাম রেখেছ জানিও, সুন্দরও অর্থবহ নাম রেখো। আমি ওর সুস্বাস্থ্য, সফল জীবন ও শতায়ু কামনা করি। শুধু কন্যার পিতা নও, তুমি সফল শ্বশুর হও, স্নেহশীল নানা হও এটাও কামনা করছি। নিরবচ্ছিন্ন সুখ, শান্তি ও হাসি-আনন্দে তোমার গৃহ ভরে উঠুক এই প্রার্থনা করি। তোমরা ভালো থেকো। তুমি ও তোমার স্ত্রী আমার স্নেহ ভালোবাসা নিও।
তোমাদের
সৈয়দ আবুল মকসুদ।
চিঠির শেষ শব্দটিতে চোখ আটকে আছে আমার। আপনি লিখেছেন ‘তোমাদের।’ বাস্তবিকই আপনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছের লোক হয়ে থাকবেন। বিদায় প্রিয় মকসুদ স্যার।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো