জুয়েল আশরাফ »
অনেক বছর ধরে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল আসীল। অবশেষে অগ্নিনির্বাপক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি নিয়ে বাড়িতে সবার প্রশ্ন ও উদ্বেগ থাকলেও আসীলের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে । ছোটবেলায় সে সুপার হিরো হতে চেয়েছিল। চলচ্চিত্রের নায়ক নয়, একজন সত্যিকারের নায়ক। যে মানুষকে সাহায্য করে। বড় হয়ে আসীল পৃথিবীর বাস্তবতা জানতে পেরে নায়ক হওয়ার ভাবনা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কোনো এলাকায় গিয়ে মানুষকে সাহায্য করার ভাবনা তার শৈশবের সুপার হিরোকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। সমাজসেবার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহ, আর কী দরকার?
সাধারণ বেতন আর জীবন-হুমকির চাকরির জন্য বাবা-মা ও বড়বোনের দুশ্চিন্তার ভেতর দিয়ে আসীল কোনোভাবে প্রশিক্ষণে চলে যায়। অগ্নিনির্বাপণের অনুশীলনে সে ব্যাচের অগ্রগণ্য। তার কাছাকাছি থাকা সঙ্গীদের উদ্দীপনা, ইতিবাচকতায় পূর্ণ করল।
প্রশিক্ষণের পর আসীলের প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয় নতুন শহরে। তার ছোট শহরের তুলনায় নতুন শহর সারাবিশ্বের মতো। যদিও নিজের এলাকায় থাকতেই পছন্দ তার। কিন্তু অন্য শহরে আলাদা আনন্দও আছে।
আসীল শুনেছে এই শহরের কিছু এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে আট হাজার লোক বাস করে। শোনামাত্রই একটি ছোট শিশুর চোখের মতো বিস্ময়ে ভরে গেল তার চোখ।
গ্রীষ্মের মৌসুমে শহরে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে অগ্নিকা-ের ঘটনা বাড়তে থাকে। আসীল ফায়ার ব্রিগেড ভ্যানে শিফটে প্রতিদিনই দুই-তিন জায়গায় যাচ্ছে। শিফট শেষ হওয়ার পরেও প্রয়োজনে পাশের ঘর থেকে ফায়ার স্টেশনে পৌঁছাচ্ছে। ডিউটির সময় বাইরে বা বেশি কাজ করা তার পক্ষে এতটাই স্বাভাবিক হয়েগেল যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর সহকর্মীরা বিষয়টি লক্ষ করাও বন্ধ করে দিল। বন্ধুরা হাসল। আসীল পৃথিবীর সবচেয়ে ইতিবাচক মানুষ। এমনকি চলচ্চিত্রের নায়কেরাও এত প্রাণবন্ত নয়। আসীল তাদের বলল, আমাদের সকলকেও আশাবাদী হতে হবে। সর্বদা ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে। আল্লাহর উপরে ভরসা রাখতে হবে।
আসীল যেখানেই গেছে সেখানে আগুন, ভূমিকম্প ইত্যাদির কারণে মানুষ আহত হয়েছে কিন্তু কেউ প্রাণ হারায়নি।
সারাদিনের ক্লান্তি, কম ঘুমিয়েও পরিবারের সবার সাথে নিয়মিত কথা হয় তার। আসীল কতবার কত লোককে বাঁচিয়েছে, অসুস্থতার মধ্যেও সে কীভাবে প্রথম স্টেশনে আসে, কীভাবে আহত ব্যক্তির আত্মীয়রা তাকে আঁকড়ে ধরেছে, কীভাবে জনতা তাকে পাথর ছুঁড়েছে, এমনকি কিছু দেরি করার পরেও তাকে মারধর করেছে।
মা! আজ তুমি বিশ্বাস করবে না। সিঁড়িতে দোল দিয়ে বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া শিশুটিকে ধরলাম, পুরো এলাকা আমার প্রশংসা করেছে। কেউ জামাকাপড় দিয়েছে, কেউ জোর করে বাড়ির তৈরি মিষ্টি খাইয়েছে। শিশুটির মা আমাকে টাকা সাধলেন। কিন্তু আমি নিইনি।
মায়ের মনে হল আসীল শুধু কথা বলেই চলেছে। তার কণ্ঠে যে সুখ প্রতিফলিত হয় তা মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ।
… তারপর মা আমাদের অন্য জায়গায় যেতে হলো। আমাদের গাড়ি ভেঙে গেল। পৌঁছানোর আগেই আমরা দেরি করে ফেললাম। ভিড় ঘিরে ফেলল। রাগে এক মহিলা আমাদের সহকর্মীকে জুতা ছুড়ে মারল। বাকিরা ভ্যানে বকাঝকা খাচ্ছে। মাইকে বুঝিয়ে বললাম, দেরি হয়ে গেছে। তবে যারা আটকে আছে তাদের বাঁচানো দরকার। তারপর মারধর করা হোক। আল্লাহপাকের দয়ায় কেউ বেশি আঘাত পায়নি। সব মানুষ রক্ষা পেয়েছে।
মা বললেন, তোর খেয়াল রাখিস বাবা, নিজেকে এভাবে ছড়িয়ে দিস না সবখানে, লোকে শোনে না…।
আসীল মাকে সান্ত¡না দিলো। বলল, মা আল্লাহ তোমার আর আমার সব কথা শোনেন। এত মাস হয়ে গেল, আমার সামনে কেউ মরেনি, আমার কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে যখন দেখতাম মানুষ জ্বলন্ত দালানে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে ভূমিকম্পে। সবাই আশা ছেড়ে দিল। তারপর আল্লাহকে বলল, শুধু তোমার দয়ায় বাঁচাও। আমরা আল্লাহর রহমতে সবাইকে বাঁচাতে পারি। আমি প্রতিদিন কয়েক ডজন মানুষের দোয়া সংগ্রহ করি। সব ঠিক হয়ে যাবে, মা, তুমি চিন্তা করো না।
আসীলের ওপর আল্লাহপাকের কৃপা আছে। চাকরির একবছর পূর্ণ হলো। একদিন তাকে শহরের উপকণ্ঠে একটি অ্যাপার্টমেন্টে আগুন নেভাতে পাঠানো হলো। কয়েকটি ফায়ার ভ্যান ইতিমধ্যেই অ্যাপার্টমেন্টে আগুন নেভানোর জন্য পৌঁছেছে। কিন্তু বিল্ডিং থেকে আশেপাশের শ্রমিকদের বসতিতে ব্যাপক আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত এলাকা ও সরু রাস্তার কারণে মানুষ বাঁচানো কঠিন। দ্বিতীয় দফা লড়াই করে দমকল বাহিনীর কিছু দল বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আসীল আল্লাহর নাম জপতে জপতে বসতির ভেতরের অংশে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে আহতদের জন্য এই অভ্যন্তরীণ এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স আর অন্যান্য সাহায্য পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে গেল।
হঠাৎ আসীলের চোখ পড়ে এক নারীর প্রাণহীন দেহের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুই দমকলকর্মীর ওপর। তারা দুজনই তর্ক করছে এই নারী বেঁচে আছে কি নেই। আসীল দ্রুত হৃদস্পন্দন নিতে কাছে পৌঁছাল। দেখতে পেল একজন সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া গর্ভবতী নারী। নারীটি কোনো রকমে, হাতের সামান্য নাড়াচাড়ায় তর্ককারী উদ্ধারকারীদের বলছেন, তিনি এখনও বেঁচে আছেন। কয়লা আলকাতরার মতো ফোর্থ ডিগ্রি পোড়ার চিহ্নসহ তার মাংস জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে আসছে। একটি হাত পেটের সাথে লেগে আছে। জ্বলন্ত অবস্থায়ও যেন সে তার সন্তানকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। যন্ত্রণায় তার শরীর হালকা কাঁপছে। আসীল তাকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঠোঁটের মাংসের সাথে পানির ফোঁটা স্পর্শ করার পরে সে আরও বেশি ব্যথায় কাতরাতে লাগল। আসীল বিশ্বাস করতে পারছে না ওর সাথে এমন কিছু হতে পারে। তার বিশ্বাস শেষ মুহূর্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এক সহকর্মী জানাল, এই নারীর পুরো পরিবার মারা গেছে। সাহায্য আসতে এখনও অনেক সময় বাকি।
নারীর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, আসীল তার বেঁচে থাকার সামান্যতম আশা নিয়েও নিজেকে সান্ত¡না দিতে পারল না। নামহীন নারীর যন্ত্রণা কাছ থেকে দেখতে পেল না, সে ভেজা চোখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকল। যদি তার হাত বারবার নারীর দিকে চলে যায়। সে ব্যথা অনুভব না করে, তবে শরীর স্পর্শ করার আগেই সে থেমে যাবে।
সর্বদা প্রফুল্ল, আশাবাদী, আজ আসীল জীবনে প্রথমবার হাল ছেড়ে দিযেছে। মুখ তুলে তাকাল, অশ্রুসজল গলায় বলল, আল্লাহ, এই নারী অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। দয়া করে এই নারীকে মেরে ফেলুন। তাকে আপনার কাছে ডাকুন। প্লিজ ওকে মেরে ফেলুন…।
আল্লাহ আসীলের ডাক শুনেছেন। নারীটি তার হৃৎস্পন্দন হারিয়ে ফেলে। ওঠানামা করা শ্বাসও বন্ধ হয়ে যায়। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আসীল চলে গেল বসতির অন্য অংশের দিকে।