আইআরআইয়ের প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন : নির্বাচনী পরিবেশ এখনও নাজুক

সুপ্রভাত ডেস্ক »

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রচেষ্টার পরও প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশ এখনও নাজুক। রাজনৈতিক সহিংসতা, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস রয়ে গেছে। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে যোগাযোগ, রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ অপরিহার্য।

এমন পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) আট দফা সুপারিশ করেছে। গত বুধবার ওয়াশিংটন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

গত ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন মিশন পাঠায় আইআরআই। মিশনটি ছিল আন্তর্জাতিক নীতি ও নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত। তারা বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনী পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা মূল্যায়ন। পাঁচ দিনের সফরে ওই মিশন রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংস্থা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ ২১টি বৈঠকে ৫৯ অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে আলোচনা করে।

প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশ মূল্যায়নে আইআরআই জানিয়েছে, তরুণদের নেতৃত্বাধীন দলের আবির্ভাব এবং প্রবাসী বাংলাদেশিসহ প্রথমবারের মতো ভোটারদের বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে তাদের ধারাবাহিক ভূমিকারও আভাস আছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নারীর অপ্রতুল প্রতিনিধিত্ব, উগ্রপন্থি আন্দোলনের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণু বয়ানের মতো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের গণতান্ত্রিক চর্চা কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, সেটা নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশের রূপান্তরের ভবিষ্যৎ যাত্রা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনের অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কিনা, তা আগামী কয়েক মাসে স্পষ্ট হবে। নিরপেক্ষতা, নিরাপত্তা এবং সংস্কারের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নির্ভর করবে। জুলাই জাতীয় সনদ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের নকশা তুলে ধরেছে। তবে এর বাস্তবায়ন অনেকাংশে পরবর্তী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। এ ক্ষেত্রে ধারাবাহিক সংলাপ, স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

আট সুপারিশ
নির্বাচন কমিশন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য অংশীজনের জন্য আইআরআই মিশন আটটি সুপারিশ দিয়েছে। অবশিষ্ট প্রাক-নির্বাচনী সময় এবং তার পরও এসব ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা গেলে, তা বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এর মধ্যে সময়সীমা স্পষ্ট করা, বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধান এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার অব্যাহত রাখার প্রকাশ্য অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে জুলাই সনদে গণভোট আয়োজনের জন্য সুস্পষ্ট ও আইনি কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে।

গণভোটের সময় ও ক্রম নির্ধারণে স্বচ্ছ আইনি ব্যাখ্যা ও ব্যাপক রাজনৈতিক ঐকমত্যই নির্দেশক হওয়া উচিত। গণভোটের উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে স্পষ্টভাবে অবহিত করা হবে আস্থা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।

নাগরিক সচেতনতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার 
জুলাই সনদ সম্পর্কে জনগণের বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে শক্তিশালী নাগরিক উদ্যোগ জরুরি। প্রস্তাবিত সংস্কার, বিশেষ করে সাংবিধানিক পরিবর্তন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভোটারদের অবহিত করতে হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশব্যাপী সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। এসব কার্যক্রমকে সর্বজনীন, সহজলভ্য এবং নতুন ভোটার, তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী করে উপস্থাপন করতে হবে।

নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
রাজনৈতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীর অধিকার সুরক্ষা, নেতৃত্ব বিকাশ, প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন এবং সংরক্ষিত আসনের বাইরেও অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারী প্রার্থী ও ভোটার– উভয়ের সম্পৃক্ততা বাড়াতে দলগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

প্রার্থী বাছাইয়ে স্বচ্ছতা
রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, পদ্ধতিগত এবং জবরদস্তি বা পক্ষপাতমুক্ত থাকে।

মনোনয়ন পর্বে স্থানীয় পর্যায়ে সহিংসতা প্রতিরোধ এবং নারী প্রার্থী ও প্রচারকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

নিরাপত্তা পরিকল্পনা সমন্বয়
নির্বাচন কমিশনকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় উত্তেজনা প্রশমন ও নির্বাচন-সংক্রান্ত সহিংসতা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। জননিরাপত্তা ও ভোটার আস্থা ধরে রাখতে যৌথ পরিকল্পনা, স্বচ্ছ যোগাযোগ প্রক্রিয়া এবং সমন্বিত সাড়াদান প্রক্রিয়া অপরিহার্য।

পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা
নির্বাচন কমিশনকে পর্যবেক্ষণ সংস্থা স্বীকৃতির জন্য স্পষ্ট ও সহজলভ্য মানদণ্ড প্রকাশ করতে হবে। এতে যোগ্যতা, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পর্যালোচনার সময়সীমা উল্লেখ করতে হবে। কোনো আবেদন প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে, যাতে জবাবদিহিতা ও আস্থা বাড়ে।
স্বীকৃত পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষতা ও অরাজনৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে তাদের কাজ বিশ্বাসযোগ্য হবে। নির্বাচন কমিশনকে এসব পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। এতে হালনাগাদ তথ্যের বিনিময়, কোনো বিষয়ে উদ্বেগ থাকলে তার সমাধান এবং নির্বাচনের আগে উত্তম চর্চা নিশ্চিত করা যাবে।

রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা
নির্বাচন কমিশনকে আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দিতে হবে। এতে নাগরিক, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ আর্থিক প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও নির্বাচনী বিধি অনুসরণ যাচাই করতে পারবে। তহবিল গোপন বা ভুল তথ্য দেখালে শাস্তি নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করতে হবে। জবাবদিহিতা ও আস্থা বাড়ানোর জন্য স্বাধীন নিরীক্ষা ও নাগরিক পর্যবেক্ষণকে উৎসাহিত করতে হবে।

অবাধ, স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য
গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সংবাদ প্রচার করতে হবে। দলীয় পক্ষপাত এড়াতে হবে। সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বা আর্থিক চাপমুক্ত থেকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নাগরিক সমাজ ও নির্বাচন কমিশনকে যৌথভাবে ভোটার সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। নাগরিকরা যেন মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য চিহ্নিত করতে পারে এবং অনলাইন আচরণের গণতান্ত্রিক প্রভাব বুঝতে পারে।