অসম্পূর্ণতার পূর্ণতা

রোকসানা বন্যা »

বসন্তের শেষ বিকেল। পার্কের বেঞ্চটায় বসেছিল অনামিকা আর আবীর। পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার রঙে মাখামাখি বাতাস। কিন্তু ওদের চোখে সেই রঙের কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না, ছিল এক অব্যক্ত শূন্যতা। অনামিকা আবীরের কাঁধে মাথা রেখেছিল, আর আবীর আলতো করে তার চুল ছুঁয়ে দেখছিল। এ স্পর্শ নতুন নয়, অসংখ্যবার ছুঁয়ে দেখা। তবুও আজ যেন এই স্পর্শেও একটা নীরব প্রশ্ন ছিল-এর পর কী?
ওদের সম্পর্কের শুরুটা ছিল খুব সরল। এক সাহিত্য আড্ডায় অনামিকার কবিতা আর আবীরের গল্পের টানে একে অপরের কাছাকাছি আসা। তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথোপকথন, লাইব্রেরির শান্ত দুপুরে বইয়ের গন্ধের আড়ালে এক নতুন জগতের সন্ধান। তাদের বন্ধুত্ব ছিল এক নদীর মতো, যা ছিল স্বচ্ছ, গভীর, কিন্তু যার কোনো নির্দিষ্ট বাঁধন ছিল না।
অনামিকা আবীরের কাছে ছিল এক খোলা জানালার মতো, যেখান দিয়ে সে দেখতে পেত জীবনের নতুন নতুন দিক। আবীরের প্রতিটি গল্পে অনামিকা খুঁজে পেত নিজের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। তারা একে অপরের কাছে মনের সবটুকু খুলে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে কোনো গোপন অধ্যায় ছিল না। বন্ধুত্বের এই গভীরতায় কখন যে ভালোবাসার বীজ উপ্ত হয়েছিল, তা তারা নিজেরাও টের পায়নি। এক শীতের রাতে আবীর যখন অনামিকার হাত ধরে বলেছিল, তোমার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, তখনই তাদের বন্ধুত্বের সীমারেখা মুছে গিয়েছিল।
তারা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়েছিল, কিন্তু সেই সম্পর্ক ছিল সাধারণ সম্পর্কের চেয়ে আলাদা। তাদের মধ্যে সেই উদ্দাম প্রেম ছিল না, ছিল না কোনো অধিকারবোধের লড়াই। তাদের সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসার এক শান্ত, গভীর সমুদ্রের মতো। একে অপরের স্পর্শ, একে অপরের উপস্থিতি তাদের কাছে ছিল এক পরম শান্তি। আবীর অনামিকাকে নিয়ে ভবিষ্যত দেখেছে, কিন্তু সেই ভবিষ্যত কখনো বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়নি। অনামিকাও চায়নি।
এর উত্তরটা ছিল ওদের দুজনেরই কাছে দুর্বোধ্য এক নীরবতা। আবীরের মনে হতো, বিয়ের মতো একটি সামাজিক অধ্যায় তাদের এই মুক্ত ভালোবাসাকে হয়তো খাঁচায় বন্দী করে ফেলবে। যে সম্পর্কটা আজ বাতাসের মতো স্বাধীন, তা হয়তো দায়িত্ব আর প্রত্যাশার ভারে নুয়ে পড়বে। অনামিকারও একই ভয়। সে মনে করত, সংসারের বাঁধন তাদের দুজনের ব্যক্তিগত জগৎকে সংকুচিত করে দেবে। কবিতা আর গল্পের জন্ম যে মন থেকে হয়, সেই মন হয়তো সংসারের ঘেরাটোপে আটকে যাবে। তারা দুজনই নিজেদের একাকীত্বকে ভালোবাসতো, ভালোবাসতো নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তাকে। আর তাই, ভালোবাসার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেও তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।
কয়েকজন বন্ধু তাদের এই সম্পর্কের গভীরতা দেখে বিয়ের কথা তুললেই তারা এড়িয়ে যেত।
আমরা তো ভালোই আছি,
আবীর হেসে বলত।
বিয়ে করলে কি আর এমন নতুন কিছু হবে! অনামিকাও সায় দিত। কিন্তু এই এড়িয়ে যাওয়াটা একধরনের লুকোচুরি ছিল।
পার্কের বেঞ্চে বসে থাকা এই নীরব মুহূর্তে অনামিকার মনে পড়ছিল গত রাতের কথা। আবীর তাকে বলেছিল,
অনামিকা আমরা কি ভুল করছি? আমাদের ভালোবাসা কি কোনো গন্তব্য ছাড়াই এভাবে চলতে থাকবে?
অনামিকা চুপ করে ছিল। সে জানে না। তাদের ভালোবাসা এক চলমান নদী, যার কোনো সাগর নেই। সে জানে এই সম্পর্কটা সম্পূর্ণ, কিন্তু সামাজিক চোখে অসম্পূর্ণ।
আবীরের হাতে অনামিকার হাতটা শক্ত হয়ে এল। আবীর তার দিকে তাকিয়ে দেখল অনামিকার চোখে জল। আবীর আলতো করে তার চোখের কোণ মুছে দিল।
কী ভাবছো? আবীর জানতে চাইল।
ভাবছি, আমরা কি সত্যিই এভাবে ভালো থাকতে পারব? একটা সময় কি আমাদের একা মনে হবে না? যখন আমরা একে অপরের কাছে থেকেও দূরে থাকব, তখন কি আমাদের এই ভালোবাসা ম্লান হয়ে যাবে না?
অনামিকার কথায় ছিল এক অসহায়তা।
আবীর তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। ভয় পেও না। ভালোবাসা মানেই তো অধিকার নয়, শুধু ভালো থাকা। আমরা একে অপরের পাশে থাকব, এভাবেই। হয়তো আমাদের সম্পর্কের কোনো নাম নেই, কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই, কিন্তু আমাদের এই ভালোবাসা কমতি থাকবেনা এটুকুই।
অনামিকা আবীরের বুকে মুখ গুঁজে বলল,
আমি শুধু এটাই জানি, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। আর তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে না।
কখনোই না, আবীর অনামিকাকে আশ্বাস দিল।
তারা জানে, তাদের এই পথটা অনিশ্চিত। সমাজের হাজারো প্রশ্ন, হাজারো প্রত্যাশা তাদের পিছু ছাড়বে না। হয়তো একদিন তাদের মধ্যে দূরত্ব আসবে, সম্পর্কের বাঁধন আলগা হবে। হয়তো তারা একে অপরের থেকে সরেও যাবে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে, এই বিকেলে, আবীর আর অনামিকা জানে তাদের ভালোবাসা খাঁটি। এই ভালোবাসার কোনো গন্তব্যের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু একে অপরের পাশে থাকার। তাদের সম্পর্কটা অসম্পূর্ণ হলেও তাতেই তারা খুঁজে নিয়েছে এক পরিপূর্ণ জীবনের ছন্দ।