নিলা চাকমা »
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ১৮০ শয্যার ক্যান্সার ইউনিট, ৫০টি ডায়ালাইসিস মেশিনসহ ১৬৫ শয্যার কিডনি ইউনিট এবং কার্ডিয়াক রোগীদের সেবা দিতে ১১৫ শয্যার জন্য ১৫ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অর্থ সংকটে তা শেষ হয়নি। মাত্র ২৭ শতাংশ কাজ শেষ করার দাবি করা হলেও দৃশ্যমান শুধু একতলার একটি নির্মাণাধীন ভবন। যদিও এর নিচে দু’তলার বেজমেন্টের অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়েছে।
চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামসহ ৮টি বিভাগীয় শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একশ শয্যার ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। চমেক হাসপাতালের প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ২৯ লক্ষ ৮১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়। কিন্ত সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন জানানো প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ভবনটির ২ বেইজমেন্ট ১৫ হাজার ৫৫০ বর্গফুট, নিচ তলা ১৬ হাজার বর্গফুট, দি¦তীয়তলা ১৪ হাজার ৯৪২ বর্গফুট, তৃতীয়তলা ১৬ হাজার ৯৬ বর্গফুট, চতুর্থতলা ১৬ হাজার ৯৬ বর্গফুট, পঞ্চম থেকে পনের তলা ১৪ হাজার ৮৮৬ হাজার বর্গফুটসহ মোট ২ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গফুটের ১৭ তলাবিশিষ্ট ভবন।
সূত্রে জানা যায়, ভবনটিতে দ্বিতীয় থেকে সপ্তম তলায় ১৮০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিট থাকবে। অষ্টম থেকে এগারো তলায় ১৬৫ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস এবং ১২ তলা থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত ১১৫ শয্যার কার্ডিয়াক ওর্য়াড করা হবে। ভবনটিতে ৯টি লিফট, ১৫০০ কেভিএ সম্পন্ন ২টি সাব স্টেশন, ৫০০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন অটো জেনারেটার, ফায়ার হাইড্রেন্ট, এয়ার কুলার, ১০০ কিলোওয়াটের সোলার সিস্টেম, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, গভীর নলকূপ, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং, মেডিক্যাল গ্যাস সিস্টেম, এপ্রোচ রোড, এবং কম্পাউন্ড ড্রেন থাকবে। এ ভবন নির্মাণে ঠিকাদারির কাজ করছে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড এবং ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড।
গত সোমবার সকালে প্রকল্পটিতে সরেজমিনে দেখা যায়- কোদাল, টুকড়ি হাতে নিয়ে ৪০ থেকে ৫০ জন শ্রমিক কাজে এসেছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ২ জন লোক শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ২ বেজমেন্ট এবং নিচতলার কাজ শেষ করা হয়েছে। তবে আস্তরের কাজসহ অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী রাহুল গুহ বলেন, ‘ক্যান্সার হাসপাতাল ভবন শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশে বিভাগীয় শহরে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে ১৫তলা ভবনটির এখন পর্যন্ত ২৭ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। অর্থের সংকটে কাজ ধীর গতিতে চালছে। এ বছর কোনো খাত থেকে অর্থ পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালে আমরা এটার টেন্ডার করেছি। তখনকার দামের সাথে বর্তমান বাজারের নির্মাণসামগ্রীর দামের অনেক পার্থক্য। যার কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের ব্যয় এখনো বাড়ানো হয়নি। তবে প্রস্তাবনা অনুসারে প্রকল্পের কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে অবশ্যই প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। আগে এ প্রকল্পে শুধু ১০০ শয্যার ক্যান্সার ওয়ার্ডের কথা উল্লেখ ছিলো। তাতে এখন যোগ করা হয়েছে আরও দুটো ওয়ার্ড -কিডনি ও কার্ডিয়াক। এজন্য প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে। খরচও সে অনুপাতে বাড়বে।
এ নিয়ে কথা হয় প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেডের ম্যানেজার মো. জামশেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, অর্থের সংকট কিছুটা রয়েছে। তবে আমাদের কাজ থেমে থাকেনি। কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।
এদিকে ভবনটি নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন কিডনি রোগীরা। কারণ সেখানে তাদের জন্য ১৬৫টি শয্যার একটি ওয়ার্ড করা হচ্ছে। তেমনি একজন সুজন হাওলাদার। তার মা ১০ বছর ধরে কিডনি রোগে আক্রান্ত। ২০১৭ সাল থেকে চমেকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন। সেখানো ভালো চিকিৎসা করালেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি চাই তাড়াতাড়ি আমাদের কিডনি ওয়ার্ডটি করা হোক। কারণ স্যান্ডরে প্রায় সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তারা একবার চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেয়, আরেকবার ফিস বাড়িয়ে দেয়। আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। যেগুলো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। যত কম সময়ের মধ্যে ভবন নির্মাণকাজ শেষ হবে, ততোই আমাদের মতো রোগীদের কষ্ট লাগব হবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কিডনি বিভাগের প্রধান ডা. নুরুল হুদা বলেন, প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে আমাদের রোগীরা উপকৃত হবেন। সেখানে ৫০টি ডায়ালাইসিস মেশিন থাকবে। যেখানে ৩ শিফটে প্রায় দেড়শো রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হবে। সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস সেবা চালু হলে একজন রোগীর ছয় মাসের জন্য একেবারে দিতে হবে ২০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে দুই সেশনে ৪১৬ টাকায় এ ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হবে। অর্থাৎ কম খরচে সেবা নিতে পারবেন রোগীরা। আমরা চাই দ্রুত কাজ শেষ হোক।
৫০টি ডায়ালাইসিস মেশিন চালানোর মতো লোকবল আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আপাতত আমাদের সে অনুপাতে লোকবল নেই। তবে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলবো। আশা করি লোকবলের সংকট হবে না।
প্রসঙ্গটি নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে শুধু কিডনি রোগ নয়, ক্যান্সার চিকিৎসার মানও উন্নত হবে, রোগীরা উপকৃত হবেন। আমাদের দেশের ক্যান্সার রোগীদের প্রায় চিকিৎসা বিদেশে গিয়ে করাতে হয় যা অত্যধিক ব্যয়বহুল। এ চিকিৎসাসেবা দেশে পেলে রোগীদের অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।