মোহীত উল আলম »
একুশে ফেব্রুয়ারি হলো বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর। এখান থেকে জন্ম নিয়ে বাংলাদেশ আজকের বাংলাদেশ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বসমাদৃত। সম্প্রতি আমার এক আমেরিকান প্রফেসর বন্ধু বাংলাভাষায় শেক্সপিয়ার অনূদিত হয় জেনে লিখেছেন যে, বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ভাষাগুলোর একটি, এবং সে ভাষায় যে শেক্সপিয়ার অনূদিত হচ্ছে এটা তাঁর খ্যাতির জন্য বিরাট গৌরবের। আর একুশের মরমি গানÑ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুুলিতে পারি’ যেমন কথা আবদুল গাফফার চৌধুরীর, তেমনি সুর শহিদ আলতাফ মাহমুদের। এই সুরটা যখনই শুনি কি যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে, কি বাঁশির সুরেÑ মন মধুর বিষাদে ভরে যায়।
যে ভাইদের আমি ভুলতে পারি না, সে বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক এবং শফিকÑ তাঁদের রক্ত লক্ষ মুজিবের মতো দানা বেঁধে আজকে আমাদের এগিয়ে যাবার বরাভয় দিচ্ছে। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই শহিদদের জীবনদান যেমন আমাদের ঐতিহাসিক সম্ভার, তেমনি ভাষা আন্দোলনের ক্রমপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো, এবং বছর গড়াতে-গড়াতে যখন দেশটির বায়ান্ন বছর চলছে, তখন আমরা সচেতন হয়ে লক্ষ করি, ভাষা আন্দোলনের নিহিত গুরুত্ব আমরা পরবর্তী প্রজন্ম ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি। পৃথিবী এখন প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের সিঁড়ির একেবারে প্রায় উচ্চধাপে আছে। সে জন্য সম্ভব হয়েছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২২ ফেব্রুয়ারি ’৫২-র সংখ্যাটার স্ক্যান্ড কপি মেসেনজারের মাধ্যমে পাওয়া। প্রথম পৃষ্ঠার আট কলামের মধ্যে একেবারে শীর্ষে ছয় কলামব্যাপী শিরোনোমে বড় বড় হরফে ছাপা হয়েছে, ‘ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলীবর্ষণ।’ এই শিরোনামের গুরুত্ব হলো ভাষা আন্দোলন হয়েছিল মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। অর্থাৎ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য এখন আমরা যে দাবি তুলি, এবং সেটি হয়নি বলে যে মনোবেদনায় ভুগি, এটি প্রকৃত অর্থে ভাষা আন্দোলনের মূল প্রেরণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আরও স্বচ্ছভাবে দেখলে বলতে হয়, ভাষা আন্দোলন মোটেও ভাষার আন্দোলন ছিল না, এটা ছিল একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন। রাজনৈতিক স্বাধিকারের ব্যাপারে পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠী নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে যেমন কিছুটা ফাঁকা উচ্ছ্বাসের মধ্যে ছিল, যখন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের দিনে মোটেও আনন্দিত ছিলেন না, এবং সেদিন কলকাতার সিরাজদ্দৌল্লা ছাত্রাবাসে তাঁর কিছু সহকর্মী ও অনুসারীকে বলেছিলেন যে, পূর্ববাংলা কড়াই থেকে চুলায় পড়েছে, সে স্বাধীনতার উদ্যমের অংশ হিসাবে ভাষার প্রশ্নটা মৌলিক উপাদানরূপে কাজ করেছে। অর্থাৎ বলতে চাই, প্রথমে যে শুরু করেছিলাম এই কথা বলে যে একুশে হলো বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর, তার আরও পেছনে গিয়ে দেখতে হবে যে, পাকিস্তান হবার সাথে সাথে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে নিজেদের জন্য একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করার প্রত্যয় জন্মায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ করার স্বপ্নটা তখনই অংকুরিত হয়েছিল এবং তারই প্রধান উপকরণ হিসেবে আমরা রাষ্টভাষা হিসেবে মাতৃভাষার মর্যাদা উন্নয়নের জন্য বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং প্রাণ দিই। আমাদের এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুধাবন করতে পারলে আমরা বুঝতে পারব, বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই মনস্তাত্ত্বিকভাাবে শুরু হয়েছিল। এবং ’৪৮ ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন সেই মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে বাস্তব উপাদান দিয়ে জোরদার করে। এবং সেজন্যই ভাষা আন্দোলন যতটা না ভাষাভিত্তিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। সে জন্যই বলতে চেয়েছি, ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া। কিন্তু সর্বত্র মাতৃভাষার প্রচলন চাওয়া এটা একটা অপরীক্ষিত স্লোগান থেকে ক্রমশ জোরদার হয়েছে। ভারত-কানাডাসহ বহু দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। কিন্তু সেগুলো মাতৃভাষা হিসেবে সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে না বা হতে পারে না।
রাষ্টভাষার প্রয়োজনটা আনুষ্ঠানিক। সরকারি, আধা-সরকারি, ব্যবসাবাণিজ্য, বৈদেশিক নীতি, ব্যাংক-বীমা, প্রকল্প বাস্তবায়ন, নির্বাচন কমিশন, ইত্যাকার রাষ্ট্রীয় কার্যে এবং বৃহত্তরভাবে শিক্ষায়তনসহ, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনে রাষ্টভাষার ব্যবহার করা হয়। এবং সেখানে যে সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহার করা যাবে বা হচ্ছে, তাও নয়। বাস্তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি প্রভাবশালী সকল প্রতিষ্ঠানে বাংলার সাথে ইংরেজি কিংবা ইংরেজির সাথে বাংলা মিলিয়ে কার্যসম্পাদন করা হয়। লিখিত তো বটেই, কিয়দংশ মৌখিকও। এই ধারার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশ নামে আমরা ইদানীং যে জিগির তুলেছি, সেটা। স্মার্ট শব্দের অনেক বাংলা প্রতিশব্দ আছেÑ যেমন দক্ষ, চটপটে, চতুর, সাবলীল, কিংবা কাবিল। কিন্তু আমাদের সরকার ‘স্মার্ট’ ইংরেজি শব্দটি বাংলাদেশের আগে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করার কারণটি হচ্ছে বাংলাদেশকে বৈশ্বিকভাবে পরিচয় করাতে এখানে মিশ্রভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এবং সে জন্য বাংলা শব্দের বদলে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে সরকারের মনে হয়নি যে, এটি ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত আবেগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কিনা। যদিও আমি বলতে চাই যে, ইংরেজি ভাষার সংস্কৃতিতে আধুনিক যুগে ‘স্মার্ট’ শব্দটি মোটামুটি ‘দক্ষ’ শব্দটিরই প্রতিরূপ। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এটির পরিভাষা কদার্থে বা ব্যঙ্গার্থে ‘চতুর’, ‘চালাক’ ইত্যাদি রূপে ব্যবহৃত হতে পারে। ‘স্মাটর্’-এর আগের একটি অর্থও রেনেসাঁ যুগে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো আর সেটি হলো ব্যথা পাওয়া বা চোট নেওয়া অর্থে।
যা হোক, রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজনের সীমানা ও প্রয়োগের ব্যাপ্তি ও মাতৃভাষার প্রয়োজনের সীমানা ও প্রয়োগের ব্যাপ্তির মধ্যে ব্যাখ্যাতীত পার্থক্য আছে। সেটার কারণ হচ্ছে, যেটি ভাষাশাস্ত্রবিদ আলথুসারসহ অনেকেই বলে গেছেন যে, শব্দের অর্থের অনিশ্চয়তা। শব্দ মাত্রই পিচ্ছিল একটি প্রকরণ। শেক্সপিয়ারের একজন ভাঁড় চরিত্র বলছে যে, শব্দ হলো হাতের দস্তানার মতো। সোজা পিঠে একটা অর্থ, দস্তানাটাকে উল্টো করলে আরেকটা অর্থ। শব্দের অর্থ নির্ণীত হয় কোন প্রেক্ষিতে সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়ে। ‘ঢোকা’ অর্থ ‘প্রবেশ’ এবং ’প্রবেশ’ অর্থ ‘ঢোকা’ হলেও, কনটেক্সট বলছেÑ কোথায় কোন শব্দটা ব্যবহার করতে হবে। শব্দের এই খেলাগুলো বা ভাষার এই ম্যাজিকগুলো রাষ্টভাষার ক্ষেত্রে নয়, মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে সম্ভব। মাতৃভাষা তাই বিস্তারে বড়, ব্যবহারে সর্বজনীন, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রভাবে রাষ্ট্রভাষার চেয়ে খাটো।
মাতৃভাষার সঙ্গে বিদেশি শব্দের সংযোজনের ক্ষেত্রে ‘স্মার্ট’ শব্দটি যেমন একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, তেমনি সব বড় ভাষার প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো সে বিদেশি শব্দ খাবেই। ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষা তার বড় প্রমাণ। ভাষার শক্তি বাড়ে কৌলীন্যে নয়, উদারতায়। এবং আমার ধারণা, আঞ্চলিক শব্দের দেদার অন্তর্ভুক্তি ভাষাকে ঋদ্ধ করে বই কমায় না। বাংলা ভাষা এখন সে যুগে প্রবেশ করেছে যখন এর এন্তার মুখ হয়েছে নিঃশেষে বিদেশি ও আঞ্চলিক শব্দ গিলতে। বাংলা ভাষার প্রবল ব্যাপ্তিকে অন্য ভাষাভাষী লোকেরা ‘ঋষ’ (চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ ‘হিংসা’ অর্থে) করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এবার চট্টগ্রামের শিরীষতলার বইমেলায় গিয়ে দেখলাম, প্রচুর বিদেশি ক্লাসিকস বাংলায় অনূদিত হয়েছে। এগুলির মান সম্পর্কে জানি না, তবে সড়কপথ ঠিক আছে। তদ্রƒপ বাংলা সাহিত্যের বইও ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অকাতরে অনূদিত হবে, সে আশা করে অমর একুশের শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি শেষ করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক।