অব্যাহত শিক্ষক নিগ্রহ, নাগরিক সমাজের নির্লিপ্ততা

হাবিবুল হক বিপ্লব »

একটা কাককে মারলে দলে দলে কাক এসে গলা ফাটিয়ে বিক্ষোভ জানায়। একজন শ্রমিককে লাঞ্ছিত করলে তার সহযোগীরা রাস্তা অচল করে দিয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হয়,এ-ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজই কেবল ব্যতিক্রম। একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলে, তাঁর হাত-পা ভেঙে দিলেও না-হয় প্রতিবাদ, না-পাওয়া যায় প্রতিকার। তাঁর স্বজাতি ভাবে, ‘এতে আমার কী আসে যায়’। অন্যরা ভাবে, ‘আগ বাড়িয়ে কেন যাবো ; যাদের ঘর, তারাই সামলাক।’
‘শিক্ষক-নিগ্রহ’ এটা যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই গণ্য হয়ে গেছে। আগে একটুখানি হইচই হতো, দু’একটি বিবৃতি বা ‘প্রতীকী কর্ম-বিরতি’র সংবাদ পাওয়া যেতো, এখন সেটা ও নেই।‘যথা পূর্বং তথা পরং’, সবকিছু ভুলে গিয়ে ‘ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে’ প্রাত্যহিক জীবন-যাপনে ব্যস্ত আমরা।
কিন্তু এবার, বিশেষত গত আগস্ট ২০২৪ থেকে আমাদের অভ্যস্ত-জীবন বড় রকমের টানা ঝাঁকুনি খেলো ; ‘মার খেয়ে হজম করায় অভ্যস্ত’ সর্বংসহা শিক্ষকেরা ‘বুকের কান্না’ গোপন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
এ-সব অবিশ্বাস্য অভাবিত ঘটনাপ্রবাহের খতিয়ান হচ্ছে:সারাদেশে অব্যাহত ভাবে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা হচ্ছে, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, শিক্ষক সমাজ, ছাত্র সমাজ সবাই চুপ।
ভাবনার ওই নতুন প্রেক্ষণবিন্দু আমাদেরকে আর একটা কঠিন ও কঠোর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এসব ঘটনার অভিন্ন দুই প্রতিপক্ষ ; নির্যাতিত পক্ষের নাম শিক্ষক, পীড়নকারী পক্ষের নাম শিক্ষার্থী (শিক্ষার্থীর সহযোগী শক্তি হিসেবে অন্য কেউ থাকলেও এরা কাজ করেছে প্রভাবক হিসেবে, মূল শক্তি হিসেবে নয়)। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে শোচনীয় বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাই, এ কী অবস্থা আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ? শিক্ষক যাদের কাছে ‘গুরুতুল্য’, ‘প্রাতঃনমস্য’ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা, তারাই হয়ে গেছে শিক্ষকের প্রধান প্রতিপক্ষ ? তারা শিক্ষককে সম্মান না দিয়ে সম্মান-হরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে? কিন্তু কেন?
মাছের পচন ধরে মাথা থেকে, সমাজের ক্ষেত্রেও তাই। ছাত্রছাত্রীরা সমাজের মাথা তো নয়ই, বোধকরি দেহের মধ্যভাগও নয়। কাজেই তাদের উগ্র, উন্মত্ত, বীভৎস রূপের মধ্য দিয়ে আমাদের নবীন-প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় যে পচন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এর স্বরূপ এবং কেন্দ্রস্থল সম্পর্কে আমাদেরকে সবিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে ?
বিজ্ঞান বলে, বেশ কটা ছোট ছোট ভূমিকম্প মিলে (ঘটে) পূর্বাভাস দিয়ে যায় যে, বড়ো ভূমিকম্প আসন্নপ্রায়। আমাদের সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের অভিঘাতগুলো বিজ্ঞান-বিচ্ছিন্ন প্রপঞ্চ নয়। বেশ কয়েকটি ঘটনা ইংগিত দিয়ে যাচ্ছিল বড়ো ঘটনা আসন্নপ্রায়। উদ্যোগ নিতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবুও বিশ্বাস করি, ‘লেট ইজ বেটার দেন নেভার’। যে-যাই বলুন, এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই, শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান বহুকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
হাটে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে, অফিস-আদালতে শিক্ষক যেন অন্ত্যজ অপেক্ষাও অন্ত্যজতর। হারাধনের দশটি ছেলের মধ্যে সর্বশেষ ছেলেটি শিক্ষার্থী, যার উপর ভরসা বা নির্ভর করা যেতো, কালক্রমে সে-ও এখন প্রতিপক্ষের ভূমিকায় চলে গিয়েছে ; কিন্তু কেন? এ-বিপর্যয়ের পেছনে অনেকেরই অনেক দায় আছে, কিন্তু এর ভেতরে শিক্ষকের কি কোনো দায়ই নেই?
চারদিকের ঘটনাবলি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে এই অশনি-সংকেত দিচ্ছে যেÑমার খেলেও, সে-কথা বলা যাবে না ; আর কে মেরেছে সেটা কুক্ষণেও মুখে আনা যাবে না, শিক্ষক হিসেবে মান-সম্মান-শ্রদ্ধা, এটা এখন গৌণ বিষয় মূখ্য বিষয় হলো লাঞ্ছনা-নির্যাতন এড়িয়ে অক্ষতদেহে বেঁচে থাকা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র লালসালু উপন্যাসের রহিমার কথা কিঞ্চিৎ বদলে দিয়ে চিৎকার করে বলতে চাই, ‘মান-সম্মান দিয়া কি হইব, মানুষের জান যদি না থাকে।’